চরৈবেতি

চরৈবেতি

 

নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়

বর এসেছে –বর এসেছে

মুহূর্তে শাঁখ উলুর কলরব আর অজস্র কণ্ঠের হই হট্টগোলে মস্ত ছড়ানো বাড়ির উঠোনটা ভরে উঠল । কচি কাঁচাদের পাশাপাশি তাদের মা মাসি পিসিরাও ঘোমটা ফেলে বর দেখতে ছুটল ।

—ও বৌমা বরণ করবে তো —  শিগগির করে এসো—

—হেম দাঁড়িয়ে দেখছিস কি ? জামাই এল যে —

—-কই বরণডালাটা হেমের হাতে দাওগো—

নানান জনের নানান কথার মধ্যে হেমাঙ্গিনী ভিড় বাঁচিয়ে সকলের শেষে দাঁড়িয়েছিল । আজ তার ছোট মেয়ে বিরাজের বিয়ে । বড় মেয়ে ধীরার বিয়ে তো সেই কোন ছেলেবেলাতেই হয়ে গেছে । ধীরার বর সুখরঞ্জন সাহেবদের আপিসে চাকরি করে ।বর্ধমানে নিজেদের বাড়ি থাকলে কি হবে ধীরা বারো বছরেরটি হতে না হতে বৌকে নিয়ে নিজের কর্মস্থল মোগলসরাইতে চলে গেছে জামাই । তারপর দু বছর কাটতে না কাটতে এই চোদ্দতে পোয়াতি হয়েছে মেয়ে । জামাই আর ভরপোয়াতি বৌকে ছোট বোনের বিয়েতে আসতে দেয়নি । বাচ্চা সুস্থভাবে হলে , প্রসূতি ও শিশু দুজনেই ভাল থাকলে শ্বশুর শাশুড়ির অনুমতি নিয়ে কটা দিন জনাইয়ের বাপের বাড়িতে এসে  মা বাবার কাছে থেকে যাবে ধীরা । 

 আজ বিরাজেরও বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। হেমাঙ্গিনীর কোল হেমাঙ্গিনীর ঘর একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবে । আজকের দিনে ধীরাটাও যদি কোলের কাছটিতে দাঁড়িয়ে  থাকত হেম একটু শান্তি পেত । তিন  ছেলের তিন জনেই বাড়ির বাইরে কলকেতায় থাকে ।  বড় আর মেজ শ্রীনাথ আর অজিত সংস্কৃত কলেজে পড়ে আর বিনোদ হিন্দু ইস্কুলে । কলকেতায় থাকার খরচ খরচা কম নয় কিন্তু সে খরচা হেম যে করে হোক  চালিয়ে নেয় । হেমের স্বামী হরিশ মিত্তির  বরাবরই রুগ্ন ।কাজ কম্ম বিশেষ  করতে পারেনা । ক্ষেত খামারের কাজ দেখাশুনাও করতে পারেনা । তার ওপর ভরসা করতে গেলে সংসারের আয় বলতে আর কিছু থাকবেনা ।তাই  জন্ম রুগ্ন হরিশ মিত্তিরের মুখমিষ্টি বৌ হেমাঙ্গিনীকে পাড়া প্রতিবেশী জ্ঞাতি কুটুম্বরা  দেখভাল করে । বলতে গেলে জ্ঞাতিদের ভরসাতেই এত বড় জমি জায়গা রক্ষা করা দেখাশুনো করা মুনিষ খাটানো ফসল উঠিয়ে বাজারে বিক্রি করার মস্ত মস্ত কাজগুলো এত সহজে উতরে যায় । জ্ঞাতিদের কাছে হেমাঙ্গিনীর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই । বলতে গেলে তাদের কাছে এক প্রকার কেনা হয়ে রয়েছে হেম । তাদের কথাতেই ওঠা বসা করে সে । জন্ম রোগা মানুষটার সেবা যতন নিশ্চিন্তে করতে পারে । তবু অনেক সময় জ্ঞাতি ভাজদের কথা মানতে খুব কষ্ট হয় । সেসব সময় হেম ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেয় যে সে জ্ঞাতি ভাজদের অন্য অনেক কথা মানলেও এই কথাটা মানতে পারবেনা । 

 বড় জ্ঞাতি ভাজ অনেক সময় বলে

—ছিনাথ আর অজিত হাতের বাইরে চলে গেছে। কলেজে চলে গেছে ।ওদের কথা শোনাতে পারবেনা । কিন্তু বিনোদ এখনো  ছোট আছে । ওকে বরং ইস্কুল ছাড়িয়ে কলকেতা থেকে নিয়ে এসে  জমি জায়গার দেখা শুনোগুলো করাও হেম । নইলে আমরা আর কত দেখব বল ? নেহাত হরিশ ঠাকুরপো রোগা ভোগা মানুষ । ফেলতে তো আর পারিনা । তাই আসি । কত্তাদের বলে ছেলেদেরকে বলে তোমাদের খোঁজ খবরটা করাই ।

হেমাঙ্গিনী লেখাপড়া জানেনা ।  তার বাপের বাড়িতে লেখাপড়ার  চল তেমন ছিলনা । বাপের আরামবাগ বাজারে দোকান ছিল । হিসেব কিতেবটা জানত বাবা ।তারা দশ বোন । ভাই ছিলনা । ভাই থাকলে বাবা তাকে কতদূর লেখাপড়া করাত জানা নেই কিন্তু তারা দশ বোনই ক অক্ষর গো মাংস । কিন্তু কি আশ্চর্য ব্যাপার হেমাঙ্গিনীর কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি একটা ঝোঁক বরাবরই ছিল ।  আরামবাগের  ধামসে গ্রামে তার বাপের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল একখানা পাঠশালা । আশেপাশের সাত আটখানা গ্রামের ছাত্ররা ওখানে পড়তে আসত । পড়া না পারলে গুরুমশাই যদুনাথ ভটচাজ্জি শাস্তি দিতেন । আবার কেউ পড়া পারলে খুব খুশি হয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিতেন । বালিকা হেম খেলুড়িদের সঙ্গে খেলতে খেলতে পাঠশালা অবধি চলে যেত । চু কিত কিত বা গোল্লা ছুট খেলতে খেলতে দূর থেকে লক্ষ্য করত পাঠশালার পোড়োদের । পোড়োরা শাস্তি পেলে হি হি করে হাসত হেম । গুরুমশাই হেঁকে বলতেন —এই কেরে তুই ? অমনি হাসছিস কেন ? এখানে লেখাপড়ার চর্চা হচ্ছে ।বাজে এয়ার্কি হচ্ছে না । মুখ্যু মেয়েমানুষ তুই । কি  বুঝবি এসব ? যা যাঃ —-

 বালিকা হেমাঙ্গিনী ভাবত —আহা ! লেখাপড়া কি  আর এমন হাতি ঘোড়া কাজ ! শেখালেই পারব । কিন্তু শেখাবে কে তাকে ? শেখালে সে নিশ্চয়ই পারত ।

 কিন্তু গুরুমশাইকে এই কথাটা কোনদিনই বলে উঠতে পারেনি সে । শুধু ভাবত একদিন ঠিক সে গুরু মশাইকে জিভের ডগায় উঠে আসা কথাগুলো উগরে দেবে । বলবে  

—–আমাকে পড়াবেন গুরু মশাই ? তাহলে আমিও মুখ্যু নাম ঘুচিয়ে দেব ।

  কিন্তু গুরু মশাইকে কোনদিনই কিচ্ছু বলা হলনা । ভাবতে ভাবতে সময় গড়াল আর আট বছর বয়সে  তার বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে  দিলেন। আর সব দিদি বোনেদের মত তারও লেখাপড়া শেখা হোলনা । বাড়িতে কখনো লেখাপড়া শেখার কথা উচ্চারণ করলে তার মা বলত —চুপ চুপ । মেয়েদের লেখাপড়া শিখতে নেই ।লেখাপড়া শিখলে বেধবা হয় ।

ওই কথাখানা বুকের মধ্যে গেঁথে নিয়ে সে আরামবাগের ধামসে গ্রাম থেকে  জনাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে এল । বরাবরের রোগা ভোগা স্বামী হরিশের ঘর সামলাতে  সামলাতে বার দশেক মা হল । তার মধ্যে পাঁচটি বাঁচল না কিন্তু বাকি পাঁচটি শিশু বাঁচল –শ্রীনাথ অজিত ধীরা বিনোদ আর বিরাজ ।

জ্ঞাতিদের কথা মেনে আর ছেলেবেলার মায়ের মুখের সেই সাবধানবাণী –লেখা পড়া শিখলে বিধবা হতে হয়—মনে রেখে  ধীরাকে প্রাণে ধরে লেখাপড়া শেখানোর কথা ভাবতে পারলনা হেম কিন্তু লেখাপড়া শেখার জন্য সে একের পর এক তার ছেলেদের কলকেতায় পড়তে পাঠিয়ে দিল । প্রথমে শ্রীনাথ গেল । তারপর সেই ভায়েদের পরপর কলকেতায় নিয়ে গিয়ে ইস্কুলে ভর্তি করে দিল । হেম শুনে নিশ্চিন্ত হয়েছিল যে কলকেতায় নাকি মস্ত সব উৎসাহী বাবু মানুষেরা আছেন । তাঁদের কাছে একবার গিয়ে পড়তে পারলে তাঁরা প্রয়োজনে নিজের গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে ছেলেদের ইস্কুল কলেজে ভর্তি করে দেন । পড়ার খরচা চালিয়ে দেন । তারপর  বিদ্যেসাগর মশাই নামে কে একজন মানুষ আছেন তিনি নাকি সকলকে  দয়া করেন। টাকা পয়সা বিদ্যে যা চাও সব পাবে তাঁর কাছে । তাঁর কাছে গিয়ে নাকি একবার হাত পেতে দাঁড়ালেই তিনি  সকলের হাত ভরে দেন ! বিধবাদের অবধি তিনি বিয়ে দিয়ে দেন ! সব জাতের ছাত্রদের সংস্কৃত কলেজে পড়তে দেন ।

 আসলে  ছেলেবেলায় ধামসে গ্রামের সেই যদু গুরুমশাইয়ের মুখে শোনা মুখ্যু  শব্দটা  কে জানে কেন বড় তাড়া করত হেমাঙ্গিনীকে । তাই জ্ঞাতিদের বিরুদ্ধে গিয়েও সে চুপি চুপি তার ছেলেদেরকে কলকেতায় পড়তে পাঠিয়ে দিয়েছিল । কিন্তু মেয়েদেরকে লেখাপড়া শিখতে দিলে তারা কি সত্যি বেধবা হয় ? এই ব্যাপারটা একবার পরখ করতে ইচ্ছে করে যে । শ্রীনাথের মুখে সে শুনেছে যে কলকেতায় নাকি মেয়ে ইস্কুল আছে । সেখানে কোন কোন মেয়ে পড়তে যায় । আচ্ছা আজ নয় মেয়েরা পড়তে যাচ্ছে, লেখাপড়া শিখছে , কিন্তু বিয়ে থা হওয়ার পর কি তারা সত্যি সত্যি বেধবা হয়ে যাবে ? এই খবরটা হেমকে কে দেবে ?

হেমাঙ্গিনীর বুকটা হু হু করে ওঠে । ধীরার বিয়ে হয়েছিল দশে । তার ক্ষেত্রে নিজের  মন নিজে পরখ করার যাহোক একটা সুযোগ পেয়েছিল হেম কিন্তু বিরাজের ক্ষেত্রে  তো সে কিছু ভাবতেই পারলনা । জ্ঞাতিদের চাপে পড়ে মাত্র আড়াই বছর বয়সের দুধের শিশু বিরাজকে সে  বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে ।

বিরাজের কাঁচা সোনার মত গায়ের রঙ দেখে হাওড়া বেতড় নিবাসী শ্রীনিবাস গুহ তাঁর বড় ছেলেটির জন্য বিরাজকে পছন্দ করে বসেছেন । গুহ মশাইয়ের বড় ছেলেটির বয়সও বেশি নয় । মাত্রই তেরো বছর । ওনাদের আর কিছু দাবি ছিলনা । একটিই দাবি যে মেয়েকে অনিন্দ্যসুন্দর হতে হবে । শ্রীনিবাস গুহ সম্পর্কে হেমের বড় ভাসুরপো বৌয়ের মামা । ভাগ্নির বাড়ি বেড়াতে এসে বৌমা পছন্দ করে ফেলেছেন ।

এই সম্বন্ধের কথা  বড় জায়ের মুখে শুনে হেম প্রথমে কেঁদে ফেলেছিল । মোটে মায়ের দুধ ছেড়েছে বিরাজ । এখন কেমন করে শ্বশুরঘরে যাবে সে ? হেমের কান্নায় বড় জায়ের মন গলেনি । শ্রীনাথ অজিত বিনোদের লেখাপড়া শেখায় বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি জ্যাঠা জেঠি । হেমাঙ্গিনী কার্যত কারোর বারণ আদেশ উপদেশ এক্ষেত্রে মানেনি । তাই একটা বড়সড় ক্ষেত্রে  মওকা  যখন এসেছে , রোগা ভোগা  হরিশের পরমুখাপেক্ষী  মুখমিষ্টি বৌটিকে বেশ একটু জব্দ না করতে পারলে চলেনা যে ! তাই বিরাজের বিয়ে নিয়ে হেমের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল ।সকলের চাপে পড়ে হেম রাজি হয়েছিল । বলা ভাল হেমকে রাজি হতে হয়েছিল ।

ধীরা বিয়েতে আসেনি । শ্রীনাথ অজিতের প্রবল বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়েও শুধু মাত্র  আত্মীয়দের  সঙ্গে সখ্যতা বজায়  রাখার দায়ে হেম তার বুকের হৃদপিন্ডটা উপড়ে এই বিয়েতে রাজি হয়েছিল । ছেলেদের বিরোধিতাকে উপেক্ষা করেছিল হেম । গ্রামের বাড়িতে এই  আত্মীয় কুটুম্বদের ভরসাতেই দুটো আয় হয় , ছেলেদের কলকেতার পড়ার খরচা চলে নিত্যি ভোগা স্বামীর চিকিৎসা চলে আর ডালভাতটা জুটে যায় । তাদের কথাকে অগ্রাহ্য করলে হয়তো তারা আর পাশে দাঁড়াবে না , মুখ থুবড়ে পড়বে সংসারের চাকাখানা ।তাই হেম  কঠিন কাজে বুক বেঁধেছিল ।

বাড়ির কারো এই বিয়েতে কোন আনন্দ ছিলনা । তবু ভায়েদের চাপা ক্রোধ আর মা বাবার দীর্ঘশ্বাস ছাপিয়ে বিরাজের বিয়েতে বেজে উঠেছে শাঁখ ধ্বনিত হয়েছে উলুর শব্দ ।অনিন্দ্যসুন্দর ছোট্ট শিশু বিরাজকে লাল শাড়ি পরিয়ে কনে চন্দন পরিয়ে পুঁটুলির মত বসিয়ে রাখা হয়েছে । একটু পরেই ঝকঝকে এক পিতলের থালায় বসিয়ে বিরাজকে সম্প্রদান করবেন বিরাজের জ্যাঠা বীরেশ মিত্তির ।  বিরাজ এত ছোট যে বিরাজের মাপের কোন পিঁড়ি পাওয়া যায়নি ।

পরের দিন শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় শ্বশুরমশাই কোলে নিয়ে নিয়েছিলেন বিরাজকে । বিরাজ মায়ের কোলে আসার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল । কাঁদছিল গুনগুন করে । তবু হেম বিরাজকে আর একবারও আদর করেনি , চুমো দেয়নি এবং একফোঁটাও কাঁদেনি । তার জায়েরা সান্ত্বনা দিতে এসে হেমের পাষাণপ্রাণ দেখে বেকুব বনে গিয়েছিল । বলেছিল

—ঢং আরকি ! এতই যদি শক্ত মন তাহলে বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার আগে এত নাটক করল কেন ?

ভাসুরপো বঊ বলেছিল

—-কপাল ভাল খুড়িমার  নইলে আমার মামার মত বেয়াই পায় ! বর্তে যাবে বিরাজ ।

 বহু জনের কথা বার্তার ফাঁকে শত সংস্কারে আবদ্ধ হেম হঠাত একটা দারুণ কাজ করে বসল ।এমন কথা যে সে বলতে পারবে এমন সে নিজেও জানত না । হেম তার তেরো বছরের জামাই সুকুমারকে একধারে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিল 

—-একটা কথা বলব রাখবে বাবা ?

কিশোর হয়ে ওঠার প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে  থাকা বালকটি  হঠাত গজিয়ে ওঠা প্রবল দায়িত্ববোধ নিয়ে বলে উঠেছিল –হ্যাঁ রাখব । কি কথা বলুন ?

—বিরাজ আজ থেকে তোমার বৌ । জানো তো ?

—আজ্ঞে ।

বালক বৌ শব্দের মানে তার নিজের মত করে জানে ।

—তাহলে কথা দাও যে বিরাজকে  তুমি লেখাপড়া শেখাবে । ওর মুখ্যু নাম ঘোচাবে ?

বালক উল্লসিত হল । এই প্রথমবার তার ওপর কেউ কোন দায়িত্ব দিয়েছে । বলল

—আচ্ছা । বউ একটু বড় হলে আমি ওকে লেখাপড়া শিখিয়ে দেব । আমি তো পাঠশালায় যাই ।

হেম এই কথায় ভারি সুখী হল । বলল 

—দেখ বাড়ির কেউ যেন জানতে না পারে । তাহলে হয়তো  ওর লেখাপড়া বন্ধ করে দেবে । রাগ করবে ।

—না না কেউ জানতে পারবে না । বৌ পড়বে ।

বিরাজ শ্বশুরবাড়ি চলে গেল । হেমের ছেলেরা মাকে অজস্রবার দুষে যে যার কলেজে বা ইস্কুলে ফিরে গেল । হেম শূন্য বাড়িতে রোগা ভোগা স্বামীকে সেবা করে সংসারের উনকোটি খেয়াল রেখে একটি মাত্র আশাকে জাগিয়ে রেখে বাঁচতে চাইল যে বিরাজ হয়তো বা লেখাপড়া শিখবে ।

আড়াইয়ের বিরাজ শ্বশুরবাড়িতে গেছিল । মায়ের কাছে যখন সে আবার বেড়াতে এল তখন তার বয়স পাঁচ । এখন সে জড়িয়ে মড়িয়ে নিজে নিজে শাড়ি পরতে পারে পাকা পাকা কথা বলে আর অ আ ক খ লিখতে পারে । তার বর সুকুমার তাকে অক্ষর পরিচয় করিয়েছে ।

হেম জানল যে খিড়কি পুকুরপাড়ে বসে মাটির ওপর আঁক কেটে সুকুমার তার বৌকে পড়ায় । গুরুগিরি করে । আর গুরুগিরির দক্ষিনা হিসেবে হাত পা টিপিয়ে নেয় । হেম শুনে হাসে । তার খুশি চলকে পড়ে । বিরাজ অজ আম লিখতে শিখেছে ।

 এর পরের তিন বছরে শ্রীনাথ ও অজিতের বিয়ে হল । বৌ এল হেমের ঘরে ।  ভায়েদের বিয়ের সময় মোগলসরাই থেকে ধীরা কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে এলেও বিরাজকে বেতড় থেকে পাঠালনা ওরা । বিরাজ চলে এলে নাকি বাড়ির কাজ কম্মের বড়ই অসুবিধে হয় ।

বিরাজ বাপের বাড়ি আসতে পারেনা । হেমের মন কাঁদে ।  সে ছেলেদেরকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে মেয়েদের খবরাখবর নেয় । তার বৌমায়েদের অক্ষর পরিচয় থাকলেও তারা ভালভাবে চিঠি লিখতে পারেনা । পড়তে পারে শুধু।

কাটলো আরো দুই এক বছর । বিরাজ বাপের বাড়িতে আসেনা , আসেনা । হেম অপেক্ষা করে থাকে কবে আসবে তার ছোট মেয়ে । বিরাজ এসে মাকে বলবে যে সে মুখ্যু নাম ঘোচাবার পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে ! অনেক বিদ্যে শিখেছে ।বিরাজের মুখ থেকে এই কথাখানা শোনার জন্য হেম অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ।

তারপর বারো বছরের বিরাজ একদিন হঠাত করে একা একা বাপের বাড়িতে আসে । তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আসার  সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে কিন্তু সঙ্গে  বাড়ির কারুকে পাঠায়নি ।

 বারো বছরের বিরাজ এসে দরজার গোড়ায় দাঁড়াল —-মা —

—কে ?? বিরাজ এলি এতদিন পরে ? জামাই আসেনি ?

 বারো বছরের অনিন্দ্যসুন্দরী  এক বিধবা সাদা থান পরে ঘরে ঢোকে । বিস্ময়ে যন্ত্রণায় হেম এক মুহূর্ত  স্তব্ধ হয়ে যায় । তারপর অস্ফূটে জিজ্ঞেস করে

—কি করে ?

জীবন বিরাজকে এই কদিনেই অনেক কঠিন করে গড়ে দিয়েছে । সে মায়ের এই প্রশ্নের উত্তরে কাঁদলনা । হয়ত বা সব কান্না গিলে ফেলতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে । বিরাজ সহজভাবে বলল

—উনি তোমার কথা রেখেছিলেন মা । আমরা অনেকদিন যাবত পুকুরধারে বসে ঘাটে পা দোলাতে দোলাতে পড়তাম লিখতাম। কেউ জানতনা । এটা  শুধু আমাদের দুজনের ব্যাপার ছিল ।

—-তারপর ? 

হেমের গলা বুজে আসে ।

—-উনি তো বেশি লেখাপড়া জানতেননা । পাঠশালাতেই যা শিখেছিলেন । তবু উনি যা জানতেন সব আমায় শিখিয়েছিলেন মা । আমরা এখন দুজনে মিলে শুধু গপ্পের বই পড়তাম গো । খুব আনন্দ হত । একদিন –

—–একদিন কী  হল ?

হেমের তর সয়না ।

–একদিন খুব  ভালো একটা গপ্পের বই পড়তে পড়তে উনি হা হা করে হেসে উঠেছিলেন । আমিও হাসছিলাম । তারপর —

—কী হল ?

—তারপর বইটা হাত ফসকে পুকুরে পড়ে গেল । আর উনি বইটা আনতে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন । শীতের ঠাণ্ডায় পানাপুকুরের জল ! ওনার ঠান্ডার ধাত ছিল । বই খুঁজতে বেশ কিছুটা সাঁতরেও ছিলেন । তারপর বই যখন পাওয়া গেল তখন সে বই আর পড়ার অবস্থায় নেই । সন্ধ্যে থেকে তাড়সে জ্বর এল ওনার । খুব জ্বর ! আর জ্বর নামলনা । কোবরেজের ওষুধেও জ্বর নামলনা । দুদিন ভুগে তিনদিনের দিন উনি চলে গেলেন ।

অজিতের বৌটি সামনেই দাড়িয়েছিল ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল । বিরাজ সেই দিকে চেয়ে বলল 

— আমার ভাগ্য । কে খন্ডাবে বল বৌ ?

  সেই ছোট্টবেলা  থেকে  লেখাপড়ার সব কথা বিরাজ আর সুকুমারের মধ্যে গোপন থাকলেও সুকুমারের মৃত্যুর পর কেমন করে যেন বিরাজের এই লেখাপড়া শেখার  একটুখানি  গল্প মহাকাব্য হয়ে গেল। প্রচার হল সর্বত্র ।বিরাজের জেঠিমারা বিরাজের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সকলেই বিরাজের লেখাপড়া শেখার স্পর্ধাকে এই বৈধব্যের জন্য দায়ী করল । শুধু হেমাঙ্গিনী নিশ্চুপে বসে রইল । এই স্পর্ধার মূলাধার যে সে নিজে ।

বোনের এত বড় বিপর্যয়ের খবর পেয়ে ধীরা এল । শ্রীনাথ অজিত সকলেই যে যার কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরল। দিন সাতেক পর শ্রীনাথ যখন কলকাতায় ফিরে যাচ্ছে হেম এসে দাঁড়াল

—কিছু বলবে মা ?

—হ্যাঁ । কলকেতায় মেয়েদের পড়ার ইস্কুল হয়েছে তোর মুখেই শুনেছি । তুই সব খোঁজ খবর নিয়ে আয় । পরের বার বিরাজ তোর সঙ্গে কলকেতায় গিয়ে ওই ইস্কুলে ভর্তি হবে ।  ইস্কুল নাকি মেয়েদের   থাকার জায়গার ব্যবস্থাও করে দেয় —-

শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলল 

—মা ? তুমি বলছ এই কথা ?

—হ্যাঁ বাবা বিরাজ এবার তোদের মত কলকেতায় গিয়ে লেখাপড়া করবে ।

ধীরা সামনে এসে বলল 

—এত বড় দুর্ভাগ্যের পরেও তুমি আবার লেখাপড়ার কথা বলছ মা ? হয়ত লেখাপড়া শেখার জন্যই ওর এত বড় ক্ষতিটা হল ।

হেম উত্তর দিল 

— ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে মা । লেখাপড়া শিখলে বেধবা হয়  কথাটা ফলে গেল দেখছি । যাই হোক যা হবার হয়েছে ।তবে আমি চাই যে বেধবা নাম পেরিয়ে এবার আমার মেয়েটা মুখ্যু নামটা পুরোপুরি ঘুচিয়ে দিক  । আর পারিস যদি বিরাজের সঙ্গে তোদের বৌয়েদেরকেও ওই ইস্কুলে ভর্তি করে দিস বাবা । গাঁয়ের বাড়ির ব্যাপার স্যাপার আমি বরাবর সামলেছি । এবারেও পেরে যাব । এজন্য বৌয়েদের গ্রামে থাকার কোন দরকার নেই বাবা ।

আমি চাই সধবা বেধবা কি কুমারী ঘরে বাইরে  মেয়েদের একটাই পরিচয় হোক — আর সে পরিচয়ের নাম শিক্ষা ……।।

নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়

 

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

14 thoughts on “চরৈবেতি

  1. অনবদ্য লেগেছে। লেখিকাকে ধন্যবাদ এত সুন্দর একটি গল্প উপহার দেওয়ার জন্য।

  2. অপূর্ব লাগল চরৈবেতি। আশাপূর্ণা দেবীর কলমের কথা মনে পড়ল। শুভেচ্ছা জানাই।

    1. অনেক ধন্যবাদ ও ভালবাসা নিও। মেয়েদের লড়াইয়ের পথটি সুদীর্ঘ ও অন্তহীন। একথা আমাদের পূর্ব সুরীরা জানতেন তাঁদের মত করে আমরা জানি আমাদের মত করে।

    2. অনেক ধন্যবাদ ও ভালবাসা নিও। মেয়েদের লড়াইয়ের পথটি সুদীর্ঘ ও অন্তহীন। একথা আমাদের পূর্ব সুরীরা জানতেন তাঁদের মত করে আমরা জানি আমাদের মত করে। সমাজের কাছ থেকে মেয়েদের অনেক কিছু পাওয়া বাকি।তাই চলুক আমাদের এগিয়ে চলার গান
      চরৈবেতি চরৈবেতি।।।।

  3. অনেক ধন্যবাদ। ভালবাসা জানাই

  4. আজ ভাবলেই অবাক লাগে ঠিক কত যুগ ধরে মেয়েদের শিক্ষার জন্য নি:শব্দে নিভৃতে সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে।

    1. সংগ্রাম চলবে। এই বিশ্বাস অমর হোক।

  5. যে কালের ওপর ভর করে আজ আমাদের হাত চলে আদালতে বা হাসপাতালে, কোন দপ্তরে বা বিমানের কক্ পিটে সেই কালের মহিয়সী র অসাধারণ গল্প।

    1. খুব ভালো লাগলো। অনেক ধন্যবাদ ও ভালবাসা । ।

  6. খুব ভালো লাগলো। অনেক ধন্যবাদ ও ভালবাসা । ।

  7. অপূর্ব লাগল । সত্যি একসময় কত কঠিন পথ পেরিয়ে মেয়েরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পেরেছিল । ♥️♥️