বিলেতে দেহাতি/ষষ্ঠ পর্ব

সুজাতা রায়
জন্ম থেকে শুনে আসছি আমার বোধভাস্যি কম। প্রথম প্রথম রাগ হলেও পরে নিজেরই সন্দেহ হতে শুরু করে আর বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত হলাম সবাই খুব একটা ভুল কিছু বলে না। নৈলে সবাই যা ভালো বলে আমার তা তেমন কেন লাগে না? পৃথিবীশুদ্ধ লোক ভুল আর আমি ঠিক? এককালে মানে আমাদের যৌবনে মান্না – হেমন্ত -কিশোর বলতে আমার দুই দিদি অজ্ঞান। অনুরোধের আসরে শেষ গান পুরুষ হলে অবধারিত এঁদের একজন আর আমি ধনঞ্জয়ের গানে পাগল।ধনঞ্জয়ের গান দিয়ে যদি কোনও দিন অনুরোধের আসর শেষ হয় ওঁরা নাকি নিজেদের মাথা মুড়িয়ে আসবে। আমি কল্পনায় মুণ্ডিত মস্তক দিদিদের দেখে হেসে গড়াগড়ি যেতাম আর ওরা বাস্তবে আমার লাগাতার পরাজয়ে উল্লাসে ফেটে পড়তো। লতা-আশা-সন্ধ্যা ছেড়ে আমার চিরকালের প্রিয়তম গায়িকা প্রতিমা। একাই গলা ফাটাতাম এঁদের হয়ে। দিদিদের সঙ্গে ঝগড়ায় এঁটে উঠতে না পেরে কেঁদে ফেলতাম। তুলসী চক্রবর্তী আর রবি ঘোষের অভিনয় আমার সেরার সেরা লাগতো। সবাই পেছনে লাগতো আমার জন্য তুলসী চক্রবর্তীর মতো দেখতে পাত্র জোগাড় করা হবে! বাড়ি শুদ্ধ লোক সুচিত্রা – অপর্ণার অন্ধ ভক্ত,আমার চিরদিন মনে হতো ওঁরা অভিনয় জানে না। বোকার মতো এসব বলেও ফেলতাম। কম হ্যাটা পোয়াতে হয়নি এজন্য। ভেবেছিলাম বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বোধবুদ্ধি হয়েছে, কোথায় কী! ফলতঃ মোনালিসা দেখে যতোটা হতাশ তার চেয়েও বেশি আশাভঙ্গ হলো আমার আইফেল টাওয়ার দেখে। আপনি চান বা না চান প্যারিসের যেখানেই যাবেন চলতে ফিরতে আইফেল টাওয়ার চোখে পড়বেই। সে নয়তো দূর থেকে দেখা। তাকে দেখবো বলে সেজেগুজে কাছে আসতেই আমার প্রথমেই মনে হলো হাওড়া ব্রিজ টাকে কেউ একদিক খুলে সোজা দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।হায় ভগবান ! ইস্পাতের এই জবরজঙ একখানা টাওয়ারের এতো জগৎজোড়া খ্যাতি! প্রতিবছর নাকি লক্ষাধিক ট্যুরিস্ট আসে একে দেখতে!
বিশ্ববিখ্যাত আইফেল টাওয়ার
আইফেল টাওয়ার দেখতে আসার আগে ট্যুর ম্যানেজারের সঙ্গে আমার একপ্রস্হ ঝামেলাও হয়ে গেল কারণ ব্রেকফাস্টের পর কটকটে দিনের আলোয় আমাদের আইফেল টাওয়ার যাওয়া ঠিক হয়েছে।এদিকে বোন বলে দিয়েছে সূর্যাস্তের পর প্রতিঘন্টায় ৫ মিনিট করে ২০,০০০ বাল্বের আলোকছটায় যে অপরূপ সৌন্দর্য ঘনিয়ে ওঠে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। কিছুতেই যাবোনা দিনের বেলায়, এখন অন্যকোথাও চলো বেলা পরলে যাওয়া যাবে।সুভদ্র ট্যুর ম্যানেজার প্রথমে না না করে উঠলেও অচিরেই বুঝে গেল পাগলের সঙ্গে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। শেষে রফা হলো আমরা দু’বার আইফেল টাওয়ার দেখবো। প্রথমে দিনের আলোয় ওপরে উঠে দ্বিতীয়বার শ্যেন নদীর ওপর ক্রূজে চেপে ঠিক টাওয়ারের নীচ থেকে।’কেন নীচ থেকে দেখবো? দু’বারই ওপরে যাবো।’ আমার গোয়ার্তুমির উত্তর – ‘ঠিক আছে দিনের বেলার টিকিট আমরা কেটে দেবো, পরেরটা তুমি নিজে কেটো’! ব্যস, আমার দম শেষ। তাও আমার জিদ্দামি কমে না – ‘ঠিক আছে উঠে আর নামবোই না’।এবার কর্তা বুট পরে মাঠে নামলেন – ‘তাহলে তুমি শ্যেন নদীর ওপর ক্রুজ এ ঘুরতে যাবে না তো?’ জোড়া ফলায় বিদ্ধ হয়ে অবশেষে রণে ভঙ্গ দিলাম।
দিনের আইফেল টাওয়ার
১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে ফরাসী বিপ্লবের শতবর্ষপূর্তির স্মারক হিসাবে নির্মিত হয় এই টাওয়ার যা পরবর্তী চল্লিশ বছর যাবত পৃথিবীর উচ্চতম টাওয়ার ছিল।গুস্তাভো আইফেল এর অন্যতম কারিগর।তাঁর নামেই এটি আইফেল টাওয়ার। তিনশো কুড়ি মিটার (১০৫০ফুট) উচ্চতার এই বিশাল টাওয়ারটি মাত্র তিনশো জন শ্রমিক দুবছর দুমাস দুদিনে বানিয়ে ফেলে। আবহাওয়া ভালো থাকলে এর ওপর থেকে আশেপাশের বিয়াল্লিশ মেইল অবধি দেখতে পাওয়া যায়। ঝোড়ো হাওয়ায় এটি সর্বোচ্চ পনেরো সে.মি পর্যন্ত কাঁপতে পারে।এতে মোট তিনটি প্ল্যাটফর্ম আর এক হাজার সাতশো বিরানব্বইটি সিঁড়ি আছে। দমে কুলোলে সিঁড়ি বেয়ে ওঠাই যায় তবে দ্বিতীয় প্ল্যাটফর্মের পর শুধু লিফ্ট ব্যবহার করা যাবে। প্রতি সাতবছর অন্তর রঙ করা হয়। রঙ করতে লাগে ষাট টন রঙ আর আঠেরো মাস সময়। এর উপরের অ্যান্টেনার উচ্চতা চব্বিশ মিটার।
জঙ্গি সংগঠন I.S.S এর হুমকিও এসেছে একে উড়িয়ে দেওয়ার তাই বিশেষ নিরাপত্তা বেষ্টনীতে মোড়া থাকে সারাবছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার এটি ধ্বংসের নির্দেশ দিলেও শেষ পর্যন্ত তা মান্য করা হ নি।
এবার আসি আসল কথায়। শুধু যে আমার বেজায় অপছন্দ তাই ই নয় এটি নির্মানের পর খোদ ফরাসী জনগন এটি নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ে।যাক আমার মতো আরবুঝো এ দেশেও কম নেই। অপরূপ প্যারিস জুড়ে সুরম্য অট্টালিকা প্রশস্ত রাস্তাঘাট সবুজে সবুজ পার্ক অসংখ্য ফোয়ারা আর বিশ্ববন্দিত শিল্পীদের তৈরি মূর্তির মাঝে এই লোহার তৈরি টাওয়ার যেন এক মূর্তিমান অসঙ্গতি।সৌন্দর্যের পূজারী ফরাসি জনগন এর বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। নির্মানের কুড়ি বছর পর এটি খুলে ফেলার ও নির্দেশ দেওয়া হয় কিন্তু তার আগেই এর খ্যাতি বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়েছে। দেশি-বিদেশী পর্যটকের ভিড় উপচে পড়তে শুরু করেছে যার অবদান দেশের অর্থনীত তে প্রচুর। এছাড়াও রেডিও যোগাযোগের অ্যান্টেনার টাওয়ার হিসেবে এর ব্যবহারের উপযোগিতার কথা বিবেচনা করে এটি রেখে দেওয়া হয়।
দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে লিফ্টে চড়ে উঠে এলাম সেকেন্ড প্ল্যাটফর্মে। লিফ্ট থেকে বেড়িয়ে প্রথম যা মনে হলো তা হলো, ভাগ্যিস! ভাগ্যিস আমার মতো কতকগুলো তেএটে বোকার কথায় এটা খুলে ফেলা হয় নি! ঝকঝকে রোদ্দুরে মাখামাখি এক শরতের সকালে পুরো প্যারিস যেন স্বর্গের মতো নীচ থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।এতো সুন্দর যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে।হাজারো পাখি র ওড়াউড়ি নদীর বুক ঘিরে।ঐ তো লুক্সর ওবেলিস্ক যাকে ঘিরে ছবির মতো কনকর্ড স্কোয়ার। পাশেই তিরতিরিয়ে বয়ে চলেছে নীলাভ সুন্দরী শ্যেণ। আরে ওই যে দূরে সোনালী টুম্ব ওটাই তো নেপোলিয়নের সমাধি – কোনদিক ছেড়ে কোন দিকে তাকাই! গলানো সোনায় মোড়া প্যারিসের দূর দূরতম প্রান্ত যেন সত্যি নয়। ঝিমঝিম করছে মাথার ভেতরটা! কেমন খটকা লাগছে , এতো দূর এতো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কি করে? আমার কি চোখ ভালো হয়ে গেল তাহলে? আনন্দে আত্মহারা আমি ! লাফাতে লাফাতে গিয়ে দূরে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে সুসংবাদ দিতেই আমার উচ্ছ্বাসে এক ঘটি জল ঢেলে হাসি চেপে বললেন – ‘দেশে গিয়েই আবার কম দেখবে!’ ‘মানে?’ ‘দূষণহীন পরিবেশে সবাই একটু বেশি স্পষ্ট দেখছে, তুমি একা নও, আমিও!’
আইফেল টাওয়ার থেকে দেখা
ভিড়ে গিজগিজ করছে সব জায়গা। গোটা পৃথিবীর মানুষ যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।অথচ কোনও চিৎকার নেই,জোরে কথা বলা নেই। বিস্ময়ের- মুগ্ধতার স্তব্ধতা যেন ঘিরে রেখেছে চারিপাশ।টাওয়ারের ভেতরে কি নেই! সুভ্যেনির এর দোকান থেকে রেস্তরাঁ, সারি সারি ওয়াশ রুম থেকে কফিকর্ণার। এমনকি স্যর গুস্তাভো আইফেল এর একটি গোপন আস্তানাও বানানো হয়েছিল সে সময় সব রকম আধুনিক সুবিধাযুক্ত। যদিও সেটিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ। হাতে অঢেল সময়। গোল প্রশস্ত চত্বরে
যে যার মতো ঘুরছি। কয়েক হাত অন্তর অন্তর টেলিস্কোপ লাগানো। চোখ রাখলেই গোটা প্যারিস তার শিরা উপশিরা নিয়ে চোখের দুয়ারে হাজির। সব জায়গার মতো এখানেও কুকুর বিড়াল খরগোশ মানুষ কোলে মা বাবা, বৃদ্ধ বৃদ্ধা, সদ্যপ্রেমে পড়া কিশোর কিশোরীর মেলা। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলাম হুইলচেয়ারে এক ভদ্রলোককে দেখে। দুটো পা নেই একটা হাত নেই শুধু একটা হাতে চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। চকচক করছে দুটি চোখ খুশিতে। উফফ কী আনন্দময় এই বেঁচে থাকা। পা নেই হাত নেই তো কি হয়েছে! বেঁচে তো আছি! মাটি থেকে এতো উঁচুতে (যতই লিফ্ট থাক কিছু সিঁড়ি ভাঙতেই হয়) একদম একা ঘুরতে আসার কথা আমরা ভাবতে পারি? এই রসদের জন্যই তো ঘুরতে আসা। শুধু দেখা না দেখতে দেখতে শেখা শুধু শেখাও না জীবনে তার প্রয়োগ।প্রতি মুহূর্তে মরে বেঁচে থাকাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে জীবনের এই জয়গান! কেন জানিনা অকারণ চোখে জল এসে গেল।
উল্টনো হাওড়া ব্রিজ থুড়ি আইফেল টাওয়ার থেকে দুনিয়া দেখা
সেকেন্ড লেভেল থেকে ফার্স্ট লেভেলের সিড়ির মুখে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। এক অতি তরুণ দম্পতি তাদের সদ্যোজাত শিশুটিকে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নামছে। সরু লোহার সিড়ি। প্যারাম এ শোয়ানো ঘুমন্ত সেই গোলাপী দেবশিশুর উপর চোখ আটকে গেল।সিড়ির সরু ফাঁদে আটকে গেছে প্যারাম,নিমেষে লাইন পরে গেল।সবাই স্হির নির্বাক প্রতীক্ষায়। বেশ কিছুক্ষণ কসরতের পর প্যারামসহ শিশু নামানো গেল। লাইনে দাঁড়িয়ে মনে মনে হাসছি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মা নেমে গেলেই তো বাবা দুহাতে প্যারামটা কাঁধে নিয়ে নেমে যেতে পারে নিমেষেই ! যতই ছবি আঁকো কোবতে লেখো টাওয়ার বানাওনা কেন বাপু ঘটে মোটে বুদ্ধি নেইকো!
তিনটি ঘন্টা যেন নিমেষে পার হয়ে গেল, এবার নামার পালা। নীচে এসে সবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে এদিক ওদিক ঘুরছি, দেখি কিছু দূরেই স্থির নিবিড় নীল জলাশয়। অসংখ্য হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। খসখস পাতা ঝরার আওয়াজ পাখির ডাক আর লালটুকটুকে পাতাওয়ালা এক গাছের নীচে ও কাঠের বেঞ্চিতে এক নবতিপর বৃদ্ধা স্থির দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে, মনে হলো যেন মূর্তি, সত্যি নয়।আমার উপস্থিতি টের পেয়েই কিনা জানি না তিনি ফিরে তাকালেন। মুহূর্তটি চিরদিনের জন্য ফ্রেমবন্দী হয়ে আমার বুকের ভেতর ঢুকে গেল। অমন নিঃস্ব চাউনি আমি জীবনে কখনও দেখিনি।
টিকিট কাটাই ছিল কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর নির্দিষ্ট ক্রুজ আসতেই আমরা চেপে বসলাম। এখানেও সেই লাইন এবং ভিড় তবে শব্দহীন নয়। একদল ছেলেমেয়ে গিটার বাজিয়ে গান জুড়েছে। ওপরে গিয়ে বসলাম। অস্তগামী সূর্যের আলো শ্যেণ-এর বুকে যেন আগুন জ্বেলে দিয়েছে। দুপাশে বাঁধানো চওড়া রাস্তা নদীর জল ছুঁয়ে পাশে পাশে টানা চলেছে বাধ্য প্রেমিকের মতো। মাঝে মাঝে সিড়ি উঠে গেছে শহরে। কখনও কখনও সিড়ির বদলে র্যাম্প। সাইকেল চালিয়ে শহর থেকে সোজা নেমে এসো নদীর পাশে ছুট লাগাও যদ্দুর ইচ্ছে। কিছুদূর পরপরই সুন্দর সব ব্রিজ। প্রতিটি ব্রিজের সাজসজ্জা অলংকরণ আলাদা এবং অসাধারন। একঘন্টার এই ক্রুজ সফর। নদীর দুপাশে শতাব্দী প্রাচীন অট্টালিকা, নির্জন রাজপথ, অসংখ্য বসার জায়গা, ভরপুর মানুষজন আর নদীর বুকে অসংখ্য নৌকা কত যে তার ধরন -ধারন কতো যে তার সাজ।
শ্যেন থেকে দেখা দৃশ্যের ঝাঁপি
পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া অপরিচিত মানুষজনের হাত নাড়া চুমু ছোঁড়া, উড়ে আসা হাসি কুড়োতে কুড়োতে কখন সময় ফুরিয়ে এলো। তীরের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ পাশের একটি অত্যন্ত সুসজ্জিত বজরার দিকে তাকিয়ে স্থানীয়রা চিৎকার করে উঠতেই আমরাও ঘুরে তাকালাম। চারিদিকে ক্যামেরা লাগানো সেই বজরায় কোনও এক নামজাদা মডেলের ফোটোস্যুট চলছে। অবাক হয়ে দেখলাম চিৎকারে সাড়া দিয়ে পুরো ইউনিট চুমু ছুঁড়ছে। সেই অসামান্যা সুন্দরীও বেরিয়ে এসে হাত নাড়ছেন, এদিক থেকে ভক্তদের ছুঁড়ে দেওয়া চুমু হাওয়া থেকে কুড়িয়ে ঠোঁটে মাখছেন।
নদীর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রজ
আস্তে আস্তে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। দূর থেকে দেখছি আইফেল টাওয়ার জুড়ে অজস্র হীরক খন্ড জ্বলে উঠলো। আস্তে আস্তে সেই সাদা হীরে হলুদ হচ্ছে সবুজ হচ্ছে বেগুনি হয়ে মহাশুন্যে মিলিয়ে গেল।আমার কেমন শীত করে উঠলো, সৌন্দর্য সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে!ক্রুজ থেকে নেমে বাসে করে আবার ফিরে এলাম আইফেল টাওয়ারের নীচে। কথা রেখেছে ট্যুর ম্যানেজার। দিনের আলো আর রাতের অন্ধকারের যতোটা পার্থক্য ততটাই পার্থক্য এই দুই সময় টাওয়ারের রূপের। ঘাড় উঁচু করে সেই অপার্থিবকে দুচোখ দিয়ে শুষে নিতে নিতে সবাই কখন বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে গেছি খেয়াল নেই। সম্বিত ফিরতেই দেখি নীচের আয়োজন ও কম আকর্ষণীয় নয়।এক অশীতিপর বৃদ্ধ – বৃদ্ধাকে ঘিরে তাঁর পরিবারের সবাই তাদের বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করছে। সবার গান, উপরে হাজারো আলোর জ্বলে ওঠার মাঝে সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার আলিঙ্গন ও চুম্বন। এক অনাস্বাদিত অনুভূতিতে ভেসে গেলাম। সেই বিদেশি অপরিচিত দম্পতি,যাদের আগে কখনও দেখিনি পরেও কখনও দেখবোনা। ঈশ্বরের কাছে তাঁদের দীর্ঘ সুখী জীবন দীর্ঘতর হোক কামনা করে অন্যদিকে রওনা দিলাম।
ঐ তো দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের সবাই।একদল কৃষ্ণাঙ্গ যুবক আইফেল টাওয়ার চাবির রিঙ কেনার জন্য একটানা পেছন পেছন ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে। শুরু হলো চৈতীর আর আমার দরাদরি। সে বলে এক ইউরোতে দুটো আমরা বলি দশটা। সে বলে – ‘ওহ্ নো ইমপশিবল ‘ আমরা বলি – ‘দিবি তো দে নইলে ফোট’, সে বলে ‘নো ফোতো ওনলি রিঙ’ আমরা হেসে গড়াগড়ি – সেও হাসে। কে না জানে আমরা হাসলে হিমালয় ও কাৎ! অবশেষে এক ইউরোতে আটটায় রফা হয় দু’ ইউরোয় ষোল খানা চাবির রিঙ কিনে বিশ্বজয়ের হাসি নিয়ে হোটেলে ফিরে দেখি এতো বেছেবুছে নেয়ার পরেও কোন জাদুতে তিনখানা ভাঙা টাওয়ার গুঁজে দিয়েছে।
কেনাকাটা সেরে এবার ফেরার পালা। শেষবারের মতো টাওয়ারের নীচে এসে দাঁড়িয়েছি। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য মানুষ। কেউ নিবিড় আলিঙ্গনে বদ্ধ, কেউ গভীর চুম্বনে। হঠাৎ আমার বহুদিন আগেকার কথা মনে পড়লো। তখন দূরদর্শন ছাড়া অন্যকোনও চ্যানেল ছিলনা। শ্রী অজিত পাঁজা ‘তথ্য ও সম্প্রচার’ মন্ত্রী হয়ে সপ্তাহে একদিন গভীর রাতে প্রাপ্তবয়স্কদের সিনেমা দেখানো শুরু করলেন। সারা সপ্তাহ হা পিত্যেশ করে শনিবারের রাতের অপেক্ষা। বিদেশী সিনেমার আন এডিটেড ভার্সন ঘরে খিল এঁটে দেখতে পাওয়া চাট্টিখানি কথা! তখনই ‘ফ্রান্সিসি কিস’ বলে একটা সিনেমা দেখেছিলাম। আজ এতযুগ বাদে খোদ ফ্রান্সের মাটিতে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে সেই জিনিস দেখবো অথচ দেখবোনা তাই হয়! চৈতীর হাত ধরে আমার নীরেনদা আর চৈতীর প্রবীরদাকে পাশ কাটিয়ে আমরা কেটে পরলাম ভিড়ের অন্যদিকে।
জগৎ চরাচর মিছে সব/ মিছে এ জীবনের কলরব। সত্য শুধু এই মুহুর্ত – তুমি আর আমি। ঠোঁটে ঠোঁট শুধু নয় আত্মা যেন লেপ্টে আছে আত্মার গায়ে। সময় থমকে আছে অনন্তের পায়ে। সর্বস্ব দিয়ে শুষে নেওয়া অমৃতের শেষ বিন্দু টুকু।
আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছি বাসের দিকে। সিমসিমে অন্ধকার মাঝেমধ্যে ছুঁয়ে যাচ্ছে টাওয়ারের রোশনাই হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম আমরা। সামনেই এক চুম্বনরত যুগল।বাপরে কী দশাশই মহিলা – এতো বিশাল লম্বাচওড়া মহিলা ঐ টিভির wwf ছাড়া কখনও দেখিনি। পেরোনোর সময় দুজনেই শত চেষ্টা সত্ত্বেও না তাকিয়ে পারলাম কই! হে ভগবান এতো ইয়ে কেশ! শেষে দুই গুঁফোর চুম্বন দিয়ে আমাদের প্যারিস ভ্রমনের মধুরেণ সমাপয়েৎ।
দারুন উপভোগ্য লেখা আপনার।
পরবর্তী ডেস্টিনেশন প্যারিস না হলে আমার বেঁচে থাকা বৃথা….
দারুণ লাগছে..
খুব উপভোগ্য। চলুক।
আমারও মানস ভ্রমণ হচ্ছে ভালোই…. আর আড় চোখে নয় , চোখ ভরে দেখলাম সুন্দর মুহূর্তগুলোকে যা শুধু দুজনার নয় পাঁচ জনও
দেখে ফেলেছে খুব সহজেই।