ওঁদের যেমন দেখেছি

৫২ হরিশ মুখার্জি রোডের সেই বাড়িটিতে যেদিন সংগীতশিল্পী ও শিক্ষক দুলালদা আমায় নিয়ে গেলেন, সেই দিন এবং যাঁর কাছে আমি গেলাম, তিনি–সমস্ত বিষয়টাই আমার জীবনের ইতিহাসে অনির্বচনীয় এক প্রাপ্তি হয়ে আছে ও থাকবে। দুলালদার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো এই কারণে। সেটা আমার জীবনের কঠিনতম সময়। প্রায় পাঁচ বছর গানের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। একটি সূত্রে প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী রেখা মৈত্রর সঙ্গে পরিচয় ও তাঁর ট্রুপের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ। সেখানেই দুলালদার সঙ্গে আলাপ। দুলালদাও আজ আর নেই। কিছু মানুষ চলে গিয়েও থেকে যান আমাদের জীবনে এভাবেই। আমার পাঁচ বছর বিরতির পর গানে ফেরা দুলালদার স্নেহ-সৌজন্যেই। প্রসঙ্গত, কলকাতার সাংস্কৃতিক জগতের মানুষের কাছে হরিশ মুখার্জি রোডের এই বাড়িটির মূল্য অসীম। প্রাচীন এই বাড়ির আভিজাত্য তার পড়ন্ত অবস্থার মধ্যেও অনুভূত হতো। আর ব্যক্তিগতভাবে এই বাড়ি আমার কাছে তীর্থক্ষেত্র বললে, একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না।
সংগীতশিল্পী ও গুরু বন্দনা সিংহ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে প্রতিবারই বড্ড আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি আমি। বস্তুত, তাঁর অজস্র গুণ, রূপ এবং আভিজাত্য, অতুলনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য–কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি ! প্রথম দিন সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছিল এমন সৌন্দর্য ও মধুরতা পৃথিবীর কোনও মানুষের হতে পারে না। বন্দনাদি আমার দেখা এমন এক নারী, যিনি যথার্থই বহু অনন্য শৈল্পিক ও মানবিক গুণের অধিকারী, সচরাচর যে গুণগুলি আমাদের চারপাশে বিরল। ওঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে, নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে, শব্দসীমায় কুলানো এক বড় চ্যালেঞ্জ ! জীবনের একটা দীর্ঘ সময়, বন্দনাদির স্নেহ, মমতা, তত্ত্বাবধান আর অন্তহীন প্রশ্রয় আমার থেমে থাকা জীবনকে গতিশীল করে তুলেছিল।
উত্তর কলকাতার এক অতি বিখ্যাত ও অভিজাত পরিবারের কন্যা বন্দনা সিংহ রবীন্দ্রসংগীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। এ ছাড়াও বাংলাগানের সব শাখায় ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর সময়ের মঞ্চ আলো করা এক সংগীত ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। রেকর্ড থেকে প্লেব্যাক সবক্ষেত্রেই বন্দনা সিংহের চাহিদা ও সাফল্য ছিল তুঙ্গে। তাঁর পরিবারের বাকি দুই সদস্য বন্দনাদির স্বামী দীপনাথ চট্টোপাধ্যায় ও ছেলে দেবমাল্য চট্টোপাধ্যায়–ওঁরাও নানাভাবে জড়িত শিল্প জগতের সঙ্গে। দীপনাথদা বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি জগতের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একটি নাম। দেবমাল্য সেসময় একটু একটু করে পেশায় আসছে। বন্দনাদি-দীপনাথদা– দু’জনে একে অপরের পরিপূরক ছিলেন। ওঁদের সম্পর্কের মাধুর্য্য ঘিরে থাকতো বন্দনাদিকেও। পরিবার সম্পর্কিত ছোট্ট, কিন্তু মরমি আর একটি তথ্য দিয়ে পরের পর্বে যাব। বন্দনাদির ছেলে দেবমাল্য এই সময়ের একজন প্রথিতযশা সংগীতশিল্পী। বন্দনাদি আমাদের অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে গেছেন। আজও কলকাতায় গেলে আমার ঠিকানা দেবমাল্যর ফ্ল্যাট।
বন্দনাদির কাছে আমার গান শেখার অভিজ্ঞতা বিচিত্র ও বর্ণময়। কবে, কখন যাব গান শিখতে, সেটা শুরুতে নির্ধারিত থাকলেও, পরে নিয়মকানুন সবই ভেঙে যায় পরিস্থিতির কারণে। ব্যক্তিগত যাপনে জর্জরিত তখন আমি। প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর অস্তিত্বের সংকট। সংসার থেকে কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াই পেশায় আসা। নতুন প্রতিষ্ঠান। সেখানেও ভাঙাগড়ার খেলা চলছে। সেই সময় বন্দনাদি, পক্ষীমাতা যেমন ভাবে তার শাবকদের রক্ষা করে, তেমন করেই আমাকে ঘিরে থাকতেন। গান শেখানোর ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য নমনীয় এক মানসিকতা ছিল বন্দনাদির। তাঁর কণ্ঠের সমৃদ্ধি, মেধা, প্রখর বুদ্ধি, দক্ষতা ও কুশলতা ছাপিয়ে উঠতো ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সহমর্মিতা।
সেই সময়ের যাবতীয় প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যতটুকু সংগীতের প্রশিক্ষণ নিতে পেরেছি বা চর্চা করেছি, সে শুধু বন্দনাদির ওই সহমর্মী মনটার জন্য। শেখানোর ক্ষেত্রে প্রতি পর্বে বন্দনাদির স্বাতন্ত্র্য অনুভব করতাম। স্বরলিপি অনুসরণ করতেন তো বটেই। কিন্তু সেটা নিপুণ মাত্রায় ভাবের যথাযথ প্রয়োগসহ। কাব্যের ওপর খুব জোর দিতেন। কী সুন্দর আর সহজ করে বোঝাতেন গানের প্রতিটি ছত্র। ওঁর মেধার ধারেকাছেও ছিলাম না আমরা ছাত্রছাত্রীরা। তবু, কারও প্রতি এমন ব্যবহার করেননি, যাতে সে হীনমন্যতায় ভোগে। উল্টে উৎসাহ দিতেন। একটু ভালো কিছু করলে–সে লেখা হোক, গান বা টিভির অনুষ্ঠান সঞ্চালনা–উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। আমার আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার পিছনে বন্দনাদির ভূমিকা কখনও ভুলবো না।
আমার জীবনে আজ অবধি এমন মমতা, অকৃত্রিম ভালোবাসা–সর্বোপরি নৈতিক সমর্থ, আর কারও কাছ থেকে পাইনি! জীবনের প্রতি আমার ভাবনা, আক্ষেপ, অভিমান, বিরক্তি, অসহায়তা–নিজের কাজের সময় নষ্ট করে সমস্ত শুনতেন তিনি। মুখ দেখলে বুঝে যেতেন, সেদিন সকালের চা-বিস্কুটের পর আর কিছু খাইনি আমি। মাস গেলে ফি দিতে না পারলে, কোনও দিন নিজে থেকে কিছু বলেননি। আমি লজ্জিতভাবে কিছু বলতে চাইলে, বলেছেন, যখন পারবে দেবে। মাসের পর মাস ফি বাকি থেকেছে। আমার গান শেখা বন্ধ হয়নি। লেডিস হোস্টেল থেকে পেয়িং গেস্ট, তারপর বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকা। এখনকার কথা জানি না। সেই সময় কলকাতা শহরে একা মহিলাদের প্রায় ক্রিমিনাল বিবেচনা করা হতো। খুবই শক্ত হতো বাড়ি পাওয়া। আত্মীয়বন্ধু তো আগেই মুখ ফিরিয়েছে সংসার-ত্যাগী পাপিষ্ঠার দিক থেকে। সেখানে সব দরজা হয় বন্ধ। নয় শর্ত মেনে খোলা। কাকে বোঝাই, শর্ত মানলে তো আর কেউ একার যাপন বেছে নেয় না। সেই কঠিন সময়েও আমি জানতাম, আশ্রয়হীন হবো না আমি। বন্দনাদির বাড়ি আছে।
বন্দনাদির মতো স্বেচ্ছা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আমি আমার জীবনে খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি। অতুলনীয় বেশ কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করবো এই প্রসঙ্গে। অত্যন্ত রূপসী ও স্টাইলিশ ছিলেন। সাজপোশাকেও অনন্যা ছিলেন বন্দনাদি। সব দিক থেকে ব্যতিক্রমী বলেই বাহুল্য ছাড়াই পৃথকভাবে নজর কেড়ে নিতেন। অথচ, নিজেকে নিয়ে এতটুকু আতিশয্য করতে কখনও দেখিনি তাঁকে। বাংলা ছবির নামী পরিচালকের পক্ষ থেকে পাওয়া সিনেমায় অভিনয়ের অফার ফিরিয়ে দেন নির্দ্বিধায়। পেশাদারীভাবে মঞ্চে আর সংগীত পরিবেশন করবেন না, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কেউ আর কখনও জোর করে বন্দনাদিকে গানের আসরে বসাতে পারেনি। নিজেকে নিবেদিত করেছেন নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের প্রশিক্ষণে। বহু নামী শিল্পীকেও দেখেছি নিয়ম করে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। অন্যদের দূর, আমি বন্দনাদির ছাত্রী–আমাকে পর্যন্ত একবারের জন্যও বলেননি ‘এটা করো বা ওটা লেখো’। বরাবর প্রচারবিমুখ থেকে গেছেন।
নির্লোভ, নিরাসক্ত–অথচ নিবিষ্ট সংসারী ছিলেন। সুন্দর করে ঘর সাজিয়ে রাখতেন, বসবার ঘরটিতে ঢুকলেই মন ভালো হয়ে যেত। রান্না করতে ভালোবাসতেন। রান্নার লোক থাকা সত্বেও, প্রায়ই হাতা-খুন্তির শিল্পকর্মে ব্যাপৃত হয়ে যেতে দেখেছি বন্দনাদিকে। ব্যস্ততার মাঝেই অতিথি আপ্যায়নে এগিয়ে আসতেন আন্তরিক আবেগে। কলকাতার সংগীত ও শিল্প জগতের মানুষের জন্য অবারিত ছিল তাঁর হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়ির দরজা। কত দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা যে কাটিয়েছি সেখানে, বলে বোঝাতে পারবো না। প্রহর কেটে গেছে। আমাদের কথা ফুরোয়নি। শেষের দিকে অসুস্থ থাকতেন। নানা শারীরিক জটিলতায় জর্জরিত ছিলেন। তবু, কখনও মুখের হাসিটুকু মলিন হতে দেননি। গেলে খুব খুশি হতেন। কাজের চাপে যেতে না পারলে ফোন করতাম। অত কষ্টের মধ্যেও কণ্ঠে ঢাকা পড়তো না অকৃত্রিম আবেগ ! সেই কন্ঠ আজও কানে বাজে। আজও সেই মায়াময় মুখটা দেখতে পাই। সর্বার্থে একজন ঝলমলে মানুষ ছিলেন বন্দনাদি। সেভাবেই আমার স্মৃতি ও অনুভবে আছেন, থাকবেন চিরদিন।
এইসব স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা ছিল না। শিল্পীজীবনের পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিজীবনও কত পরিশীলিত আর সুচারু! ভাল লাগল খুব।