কুয়ো দর্শন পর্ব – ১

কুয়ো দর্শন পর্ব – ১

সঙ্ঘমিত্রা রায়চৌধুরী দাশগুপ্ত 

 

আমার যে কোনো লেখাতে বড়কাকুদাদু ঢুকে পড়েন টপাস্ করে। এড়াতে পারি না কিছুত্তেই। এমন নয় যে ওঁর কথা আমি রোজ ভাবি। উনি আমার জীবনের আইডলও নন। বরং, সচেতনভাবে বরাবর চেয়েছি ওঁর মত না হতে। অথচ দেখুন, যে বিদ্যেটুকুর ভরসায় নিজের ঠ্যাংদুটোয় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, দানাপানি জোটাতে পারছি, তার ভিতটুকু তৈরি করে দিয়েছিলেন কিন্তু ওই  বড়কাকুদাদুই। 

 

বড়কাকুদাদু, আমার বাবার বড়কাকু, ছিলেন বদমেজাজি, প্রভুত্বকামী, প্রবল রক্ষণশীল, বিদ্যানুরাগী এবং চিরকুমার। স্নেহ ছিল, তবে অন্তঃসলিলা, স্নেহের প্রকাশ ঘটতো তিরস্কার, মুখঝামটা, দাঁতখিঁচুনি ইত্যাদির ভেতর দিয়ে। বাবিদাদু, অর্থাৎ বাবার বাবা,ছিলেন মিতভাষী, মধুরস্বভাব, অভিজাত প্রকৃতির মানুষ।  আমাদের একান্নবর্তী পরিবারটিকে নিয়ম আর শাসনের নিগড়ে বেঁধে রেখেছিলেন বড়কাকুদাদু। দাদুর ডাকনাম ছিল শিবু, গল্প শুনেছি দাদুর ছেলেবেলায় নাকি ওঁর ঠাকুমাকে একবার ” নমঃ শিবায়” আওড়াতে শুনে, নাতিকে নিয়ে মস্করা করছেন ভেবে ডাশা নিয়ে তাড়া করেছিলেন। ‘ মর্নিং শো’জ দ্য ডে’ প্রবচনটিতে আমার অন্ধ বিশ্বাস জন্মায় এই ঘটনাটা জানার পর থেকে। 

 

আরো শুনেছি, আমার জন্মাবার খবর শুনে নাকি বেজায় অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন বড়কাকুদাদু। একে মেয়ে, তায় চড়ুইপাখির মত সাইজ। মাসকয়েক বয়স হওয়ার আগে মুখও দেখেননি ভালো করে। তারপর আস্তে আস্তে প্রিয় হয়ে উঠেছি, স্বভাববিরুদ্ধভাবে অঢেল স্নেহ দিয়েছেন আমাকে। পরে ভেবে দেখেছি, তার কারণও ছিল। আমি স্বভাবে ছিলাম পড়ুয়া এবং অতি অনুগত। রোজ সন্ধে না হতেই পড়তে বসতে হত দাদুর কাছে। আমার বয়সী ছেলেপুলেরা যখন সারা বিকেল মাঠে হুটোপুটি করে কিম্বা সাইকেল চালিয়ে, নিদেনপক্ষে রান্নাবাটি খেলে, পুতুলের বিয়ে দিয়ে, বাড়ি ফিরে পড়া ফাঁকি দেওয়ার ফিকির খুঁজছে কিম্বা পড়তে বসে ঢুলছে, আমি তার বহু আগেই আমার বই-রাখার ছোট্ট রেক্সিনের স্যুটকেসটা নিয়ে গুটিগুটি  হাজির হয়েছি বড়কাকুদাদুর কাছে। কাঠের জলচৌকির দু’দিকে বসে কে.সি. নাগ আর নেসফিল্ড চর্বণ করছি দুজন মিলে। এলসিএম- জিসিএম ফ্রেজ ক্লজ ইত্যাদি হাবিজাবি খানিক ধীরলয়ে  শিখলে কী এমন ইতরবিশেষ হত কে জানে! দাদু ডাকলে সাড়া দিতে হত সঙ্গে সঙ্গে, স্নান-হিসু-হাগু যে পরিস্থিতিতেই থাকি না কেন! নইলে ফিউরিয়স হয়ে যেতেন। শুধু সাড়া না, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে সামনে দাঁড়াতাম। যা নির্দেশ দিতেন, পালন করতাম সঙ্গে সঙ্গে। অমন বাধ্য প্রজা পেলে কোন্ প্রভু না তৃপ্ত হবেন বলুন তো? 

 

স্ত্রীজাতিকে এমনিতে খানিক নীচু নজরে দেখলেও মিসেস গান্ধী আর ডঃ রমা চৌধুরী এই দুই নারীর প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা ছিল দাদুর। সেই ক্ষমতাপ্রীতি আর বিদ্যানুরাগের গল্প। ক্লাস এইট অবধি আমার পুঁথিগত পড়াশোনা এবং আত্মিক উন্নতির সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পড়াশোনায় অবহেলা হবে এই কারণ দর্শিয়ে খেলাধুলোর ধার মারাতে দেননি আমাকে ছেলেবেলাতে। আমার মাতৃকূলে বহমান ছিল, এখনো আছে,শিল্পের প্রতি সহজাত ভালোবাসা। মা চাইতেন আমার ভেতরে সুর আর ছন্দের জাদু বুনে দিতে শৈশব থেকেই। একবার রবীন্দ্র-জয়ন্তীর মহড়া দিয়ে ফিরতে আধঘন্টাটাক দেরি হওয়ায় সে কী অশান্তি! আমার নৃত্য-প্রশিক্ষণ পর্বটিকে বরাবরের মত আহুতি দিয়ে নির্বাপিত করা হল সে ক্রোধানল। “মেয়েমানুষের ধেই ধেই করে নাচার কী দরকার!” চোখ ছলছল করে এলেও, কান্না গিলে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিল মা। সারা বছরে হাতে-গোনা ক’টা দিন মা-বাবা-ভাইদের কাছে যেতে পারতো আমার মা। আমার গরমের ছুটি আর শীতের ছুটিতে, বড়জোর হপ্তাখানেক করে। হাপিত্যেশ করে থাকতো দিনগুলোর জন্য। দাদুর অনুমতি পাওয়াটাই ছিল লাখ-টাকার প্রশ্ন।এক হপ্তার অ্যাপ্লিকেশন পেশ হলে, পাঁচদিন অ্যাপ্রুভড হত, পাঁচদিনের হলে তিনদিন। আর প্রতিবার চাইতেন যেন আমাকে না নিয়েই যায় মা। দোহাই দিতেন পড়াশোনার, কিন্তু এখন বুঝি আসল কারণ ছিল স্নেহ নামক বিষম বস্তুটি। মুখে বলতেন না, পাছে কুলিশকঠোর যূথপতির ইমেজটা টাল খায়! 

 

এতক্ষণ যার কথা বলিনি একবারও, সে আমার বাবা। বুনো ওল পেইটার ফ্যামিলিয়াসের বিপ্রতীপে বাঘা তেঁতুল ভাইপো। পারস্পরিক শ্রদ্ধা-নির্ভরতার অভাব ছিল না, তবে দাদুর অযৌক্তিক ( কখনো কখনো আপাতদৃষ্টিতে হৃদয়হীনও) সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে দেখেছি বাবাকে। প্রতিবার না হলেও, প্রায়ই। নব-নালন্দায় ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রবল আপত্তি ছিল দাদুর। কমলা গার্লস, বেলতলা, কারমেল কনভেন্ট, মেয়েদের ইস্কুলের কী অভাব আছে নাকি কোলকাতায়! চুপচাপ ডিফাই করেছিল বাবা। মামাবাড়ি যাওয়া নিয়েও যখন দড়ি-টানাটানি তুঙ্গে উঠতো, তখন, অন্যান্য সময়ে সাংসারিক ব্যাপারে একটুও নাক না-গলানো আমার বাবা রণাঙ্গনে আবির্ভূত হত আর কী এক জাদুবলে পাঁচদিন এক হপ্তা হয়ে যেত, ‘টুম্পাকে নিয়ে যেতে হবে না’ হয়ে যেত ‘টুম্পা যাক, কিন্তু শুধু হাসিখেলায় দিন বইয়ে না দেয়, হলিডে হোম-ওয়ার্ক সেরে রাখতে হবে’। 

 

এখন যখন পেছন ফিরে দেখি, বুঝি ক্ষমতার যে রাজনীতি, তার হাতে-খড়ি হয় পরিবারের ভেতর থেকেই। বিভিন্ন স্তরে। যৌথ পরিবারের গৌরব-গাথাকেও মিথ বলে মনে হয় মাঝেমাঝে। শৃঙ্খলাবোধ আর সহনশীলতার কিছু জরুরি পাঠ দেয় বটে একান্নবর্তী পরিবার, কিন্তু বৈষম্যের বীজও যে বুনে দেয় রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সে কথাই বা অস্বীকার করি কেমন করে? মেনে নেওয়া, কেয়ার করা, মানিয়ে নেওয়া, আনুগত্য মস্ত গুণ নিঃসন্দেহে, কিন্তু পারস্পরিক না হলে এগুলোই তো নিগ্রহের শস্ত্র হয়ে ওঠে, বলুন? 

 

তিক্ততা কিছু আছে বটে,তবু সেটুকুই শেষ সত্য নয়, সবটুকু তো নয়ই। এমন বৈচিত্র‍্য, শত বিরোধেও বেঁধে বেঁধে থাকা, এত যে স্নেহ, নির্ভরতা, শ্রদ্ধা তার মূল্যও কি কিছু কম নাকি? অদ্ভুত নানা ফতোয়া জারির জন্য, একমুখী রক্ষণশীল ধ্যানধারণার জন্য যাঁর ওপর রাগ-অভিমান আজও তীব্র, তাঁর অবদান আর আত্মত্যাগও যে বড় কম ছিল না তাই বা অস্বীকার করি কেমন করে!   

 

শেষপাতে চাটনিই ভালো,কী বলেন?ওর টক-মিষ্টি স্বাদে মজা আছে বটে, তবে এক চিমটে নুন না দিলে কিন্তু পুরোটাই বিস্বাদ, মানেন তো? আমার দুঃখু হতাশা আর অল্প অল্প দীর্ঘশ্বাস ওই নুনটুকু হয়ে মিশে আছে এ গল্পে। ক্লাস এইট না নাইন মনে নেই ঠিক, ছোট্ট দুটো অদৃশ্য ডানা গজিয়েছে, যেমন ও বয়সে হয় আর কী, মনে অল্প অল্প পুলক। দোলের দিন বেলা সাড়ে দশ-এগারো নাগাদ এক দঙ্গল ছেলেপুলে আবির্ভূত হল বাড়িতে আবীর-টাবীর নিয়ে, বিনা নোটিশে। সবই ইস্কুলের বন্ধু, একজন বিশেষ বন্ধু হওয়ার নীরব আর্জি নিয়ে বাকিরা বন্ধুকৃত্য করতে। আমার বালকটির প্রতি তেমন মনকেমন না থাকলেও, অ্যাত্তোজন মিলে আমার জন্য এসেছে, ছাতি-টাতি একটু ফুলবে না, বলুন? পুরো ফুলে পারেনি, আর ওরাও সবক’টা সিঁড়ি পেরোয়নি, তার আগেই পেছন থেকে ব্যাঘ্রগর্জন, “কী ব্যাপার?কী চাই? পড়াশোনা নেই তোমাদের? না বলে-কয়ে চলে এসেছ! বাড়িতে কেউ কিছু বলে না??” আমার ফুলে-ওঠা ছাতি তখন চুপসে পেটের ভেতর সেঁধোতে পারলে বাঁচে আর নবীন কিশোরের দল দুদ্দাড়িয়ে তিনতলা থেকে সটান বড়রাস্তায়। তারপর থেকে আমার কাছে বেশি ঘেঁষতো না ছেলেপুলেরা। আমাকে দেখলেই নাকি বাঘের ডাক শুনতে পেত ব্যাকগ্রাউন্ডে! 

 

বয়সকালে যে একটা ধামাকাদার প্রেম-টেম হল না, অ্যাডভেঞ্চার, থ্রিলার, মিস্ট্রি কোনো গল্পই তৈরি হল না কৈশোরে, তার দায় স্বীকার না করেই তো কেটে পড়েছেন ভদ্রলোক,সেও  বহুবছর হয়ে গেল, আমি বাঁধা রয়ে গেছি ক্ষোভে- অভিমানে- কৃতজ্ঞতা-ভালোবাসায়। 

 

সারা জীবনের মত।

সঙ্ঘমিত্রা রায়চৌধুরী দাশগুপ্ত

 

পুকুরঘাট

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

12 thoughts on “কুয়ো দর্শন পর্ব – ১

  1. খুব ভালো লেখা। একনাগাড়ে পড়ে গেলাম।

  2. কুয়ো দর্শন পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে ছেলেবেলার শাসন অনুশাসনের প্রলেপগুলোই মানুষকে ধীরে ধীরে গভীর করে তোলে। দারুণ লেখা❤️

  3. চমৎকার যথারীতি। তোমার এই বড়কাকুদাদু কে তো চিনি। শুধু লেখায় নয়, পুরোন বাংলা ছবিতেও এদের দেখা যেত একটা সময়। আর আমাদের বয়েসী অনেক বাড়িতেই। এরকম চিরকুমার বা অকৃতদার মানুষেরা থাকতেন। তাঁদের প্রতাপে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খেত। অনেক অন্যায় হুকুম টুকুম চালাতেন বটে। আবার ওই যে বললে বেঁধে বেঁধে থাকাটাও সেই মানুষগুলোর জন্যই অর্জিত। চমৎকার শুরু করেছ। পরের এপিসোডের জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু একটা কারণে এই দাদু টিকে পছন্দ হল না। যদি সত্যি বলে থাকো কুসুম কুসুম কৈশোরে একটাও প্রেম করতে পারো নি সঙ্ঘমিত্রা? ইসসস। সে সময়ের প্রেমের মত এমন বুকধুকপুকুনি, এমন হাতের তেলো ঘেমে যাওয়া, নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘামওয়ালা, পা ভারি হয়ে আসা মূহুর্তগুলো মিস করেছ। হয়ত সে সব ঠিক প্রেম নয়। মোহ। কিন্তু কি মোহনীয় মোহ!! আর যদি বড়কাকুদাদুর অদৃশ্য চাপ এখনো থেকে থাকে আর তাতেই পুকুরঘাটে পা ডুবিয়ে বসেও কেঁপে উঠে সত্যিটা চেপে যাও তার চেয়ে ভালো আর কিচ্ছু হয় না। পরের কিস্তির জন্য পুকুরঘাটে বসে রইলাম।

  4. অপূর্ব লেখা। নির্মেদ, সাবলীল আর ঝকঝকে। লেখনীটি এমন সোনায় মোড়া থাকুক।

  5. দারুণ লাগল।টান টান লেখা।অনেক কিছু ভাবায়।

  6. তোর লেখার এই অনাবিল ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে।
    পড়তে পড়তে বুঁদ হয়ে যাই।

  7. এই অভিভাবকদের অভাবেই আজ এত দৈন্য বাঙালির মানসজগতে। এঁরাই ঘরের মধ্যে বন্দী রেখেও সমস্ত জগত দর্শন করিয়ে দিতেন।
    চমৎকার লেখা।

  8. রান্নাঘরের উনুনের তাপে মায়ের মনের তাপ কি চাপা পড়ে যেত, এখন তাই ভাবি। কুঁয়ো দর্শনে কিসের দেখা পাব ভাবতে ভাবতে চল্লিশ বছর আগের এক সন্ধ্যে বেলার শতরঞ্জি পাতা পড়ার ঘরে পৌঁছে গেছিলাম।

  9. কুয়ো দর্শন খুব সুন্দর মনভরানো লেখা। আরো উপভোগ করলাম এবং একাত্ম অনুভব করলাম নাম মাহাত্ম্যে। আমার নামও টুম্পা।

  10. কি মিষ্টি! কি আন্তরিক লেখা! এখন এমন বয়স যে এগুলো পড়লে মনে হয় কত কিছু হারিয়ে গেছে জীবন থেকে।