সুরতব্যাপারলীলাবিধৌ – কিন্তু সম্মতিক্রমে

শুভদীপ মৈত্র
পরপুরুষ ও বরপুরুষ এই দুটো শব্দবন্ধ নিয়ে ভাবতে গিয়ে দেখলুম ব্যাপারটা বিস্তর প্যাঁচালো, কারণ এর কোনো সর্বজনীন অর্থ মিলবে না – মহিলাদের চোখে এরা যেমন দুটো আলাদা মানুষ, পুরুষদের কাছে সেটা নাও হতে পারে – একই লোক কোনো সময় পরপুরুষ আবার কোনো সময় বরপুরুষ। দুই পরিচিতি নিয়ে চলা পুরুষের অসম্ভব নয়। যেমন ধরুন নগেন্দ্র কুন্দনন্দিনীর কাছে পরপুরুষ, সেই নগেন্দ্রই সূর্যমুখীর কাছে আবার বরপুরুষ, ভেবে কুল কিনারা পেলাম না সে নিজের কাছে তাহলে কী? নগেন্দ্রর বোধহয় সবচেয়ে বড় সমস্যা সেটাই বোঝা, সে নিজের কাছে সে-ই, একই নগেন্দ্র বটে। শুরুতেই বিষবৃক্ষ টেনে আনলুম এতে আপনাদের মনে সন্দেহ দেখা দিতে পারে আমি বোধহয় খুব একটা পরকিয়া সম্বন্ধে নৈতিকতার ফিরিস্তি শোনাব, তা কিন্তু নয়। রাধা-কৃষ্ণর লীলার কথাও বলতে পারতুম, স্বকীয়-পরকীয় দর্শন দিয়ে খানিক মোলায়ম করে নিয়ে, তাহলে ভাবতেন লাম্পট্যের হয়ে শামলা চাপিয়ে সওয়াল করতে নেমেছি। আমার দুটোর কোনো উদ্দেশ্যই নেই। যার যাতে মজে মন, সে স্বকীয়তে কেউ খুশি থাকে, কেউ পরকীয়তে।
পরকীয় কামগন্ধহীন হলে তো নৈতিকতার কোনো আপত্তি থাকে না, তাই এখানে তেমন সম্পর্ক ধরছি না। না-হলে মুশকিল হয়ে যেত, একবার ভাবুন স্বয়ং গুরুদেবের গান – ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে’, গুরুদেব একেবারে তার মাঝখানে ঢুকিয়ে দিলেন ‘আয় তোরা আয় আমার কাছে’ – লক্ষ্য করুন, আয় ‘তুই’ আয় নয়, ‘তোরা’। এই বহুবচনটাকে যদি – গুরুদেব তাই অবশ্যই প্ল্যাটনিক প্রেম তাই উচ্চমার্গীয় তাই নিশ্চয়ই কামগন্ধহীন – ধরে না নিই তাহলে কিন্তু প্রায় অর্জি বা রাসলীলা মানে করা যেতেই পারে। আমরা করি না বলেই কামগন্ধহীন রোম্যান্টিক ইনোসেন্স হিসেবে চালিয়ে দিতে পারি। রবি ঠাকুর পরপুরুষ না বরপুরুষ এ-নিয়ে লেখার জন্য অবশ্য অনেক বিশেষ-রূপ-অজ্ঞ এবং তাঁর খেউড়ানন্দ ভনার জন্য এক বন্দো-ঘটি রয়েছেন এ হাটে, আমা হেন বারেন্দ্র ভদ্র-সন্তানের সে কাজ নয়, কিন্তু লক্ষণীয় হল যে পরকীয় বা বরকীয় দুই প্রেমের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে যৌনতার বিষয়টা পাকাপাকিভাবে। অর্থাৎ ব্যাপারটায় এ-মার্কা না লাগলে ঠিক জমে না আরকি – সে তর্ক, আলোচনা যাই বলি না কেন। এই ধরুন প্রায়সই দেখা যায় বউটি তার বরপুরুষটির হোয়াটস্যাপ, মেসেঞ্জার ইত্যাদি বাচ্চার হোমওয়র্কের মতো নজরে রাখেন, তো তাতে কোনো সুন্দরী তরুণীর মেসেজ বে-সময়ে ঢুকলে অথবা সংখ্যায় দুয়ের থেকে চার হলে এই অভিযোগ করেন না যে তোমরা কার্ল মার্কস কী কথাকলী নৃত্য নিয়ে কেন আলোচনা করছ, অভিযোগ স্পষ্ট – বিছানা-সংক্রান্ত-কম্মটির দিকে কতটা এগিয়েছ নির্লজ্জ? উল্টোদিকে বরপুরুষটিও তথৈবচ, তার একই অঙ্গে দুই রূপ দেখে তার মনটা অন্যরকম ভাবলে ঠকতে হবে। কারণ এই স্বামী শব্দটির ইংরেজি অর্থটাকেই মোটামুটি বেশিরভাগ ধরে নেয়, অর্থাৎ খামার-মালিক। সে পর-পুরুষ হিসেবে স্বয়ং কেষ্ট ঠাকুরটি নিজেকে ভাবতে পারে, কিন্তু খামার-মালিক হিসেবে বউটির প্রতি তার মনোভাব একেবারে ওথেলো। কারণ ওই মালিকানা।
ইরোটিক লাভের মধ্যে মালিকানার খাদ মিশে ব্যাপারটাকে আর সুন্দর রাখে না। কতটা কুৎসিত হতে পারে, উনিশ শতকের বটতলা যদি-বা না পড়েন নিরদচন্দ্র চৌধুরির ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ পড়ুন তাহলেই বুঝবেন আর্ট অফ সিডাকশান নয়, তা বাবু শ্রেণীর কাছে ছিল নেহাত ফুঁসলনো। আর সেটা কোন কদর্যতায় বাঙালী পুরুষ নামিয়েছিল সে-দিন, তা পড়লে গা রি-রি করবে। নীরদবাবুর মতে এ ওই সৌন্দর্যচেতনার অভাব। যৌনতার সঙ্গে যদি সৌন্দর্যচেতনা না মেশে তা বিকৃতিতেই পর্যবসিত হয়, তাঁর ভাষায় লোচ্চামি। এর এক সুন্দর উদাহরণও তিনি দিয়েছেন, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে কামের দুটো রূপ একটা বৈশিক আরেকটা রোম্যান্টিক, তাঁর মতে মানুষ শুধু ‘প্রিমিটিভ’ ও ‘সিনিকাল’ কাম নিয়ে থাকতে পারে না – ‘তৃপ্তির জন্য কামের একটা অন্য রূপ চায় যাহাতে প্রাণরস ও মাধুর্য থাকে। সেই জন্যই প্রাচীন ভারতবর্ষে কামের একটা রোম্যান্টিক রূপ দেখা দিয়েছিল। ইহাতে কাম একটা নতুন সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠিল।’
আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে অন্তত মেধাবী ও নান্দনিক উচ্চারণ দেখা গেছে যুগে যুগে। খাজুরাহ-কোনার্ক ছেড়েই দিলাম সবাই দেখেছেন সে-সব, এক নারী কবির কবিতার কথা বলি, ভট্টারিকা শীলা, তিনি লিখেছিলেন ‘সা চৈবাস্মি তথাপি তত্র সুরতব্যাপারেলীলাবিধৌ/ রেবারোধসি বেতসীতরুতলে চেতঃ সমুৎকন্ঠতে।।’ এই কবিতা বৈষ্ণব তাত্ত্বিকেরা রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের কবিতা বলে চালিয়ে দিলেও এর উৎস তারও আগে। কবিতাটা ধর্মীয় দর্শন বাদ দিয়েই পরকিয়া প্রেমের মনস্তত্ব নিয়ে, ভাবুন একবার সে যুগে দাঁড়িয়ে এক মহিলা ভাবছেন সেই রেবানদী একই রয়েছে, সেই বসন্তকাল, তখন যে পরপুরুষ আমার কৌমার্যহরণ করেছিল সে এখন আমার বর, আমার সঙ্গেই রয়েছে – তবু আমার ওই রেবার তীরে অশোক বনের হাওয়ায় মন আকুল হচ্ছে সুরত ব্যাপারে কার জন্য? এই উচ্চারণ যিনি করেছেন তিনি সবচেয়ে ভাল জানেন পর-পুরুষ আর বরপুরুষে পার্থক্য। বিষয়টা সুরতব্যাপারলীলাবিধৌ। এই সৌন্দর্যই চারিয়ে গেছে বৈষ্ণব পদাবলীতে, আর তা আমাদের পদাবলী সাহিত্যের পরকীয়াকেও কমনীয় করে তুলেছে। ভিক্টোরিয় মর্যালিটির পাঠে আমরা অভ্যস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত ভারতীয় শৃঙ্গার সাহিত্যকে কেউ অশ্লীল যেমন বলেনি, আবার উনিশ শতকের বটতলার সাহিত্যকে কেউ কাব্যরস বলে চালাতে .
চায়নি (কোনো-কোনো সাবলটার্ন তাত্ত্বিক এদের মধ্যে কাব্য খুঁজে পান এ-কথা পড়েছি, তবে পাঠক তাঁরা অনেক কিছুই বলেন যা তাঁদের পুঁথি আর টোলের চত্ত্বরেই থেকে যায়, ও আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকের অকাম), অর্থাৎ ডেকাডেন্স বা ক্ষয়িষ্ণু বিকৃতি একটা টালমাটাল সময়ের সাক্ষ্য, মানুষ তার সুস্থ অবস্থায় সৈন্দর্য্যকে বুঝে ফেলতে ভুল করে না। তাই বটতলার হরিদাসীর গুপ্তকথার বদলে জয়দেব-বিদ্যাপতিকেই কাব্য হিসেবে পড়বে, যেমন পড়বে শীলা ভট্টারিকাকে।
শীলা ভট্টারিকাই আসলে স্যাফো, আসলে সিমন দ্য বোভাঁ, আসলে অ্যানাইস নীন। যে নারী যুগের পর যুগে বুঝেছে সম্পর্ক ব্যাপারটা নিয়মের চৌকাঠে আটকে রাখলে তা আর সম্পর্ক থাকে না। অর্থাৎ যে বিষয়টা বলতে চাইছি তাহল দূরকে করলে নিকট, নিকটকে দূর, এই হোক মটো, পর ও বরের দ্বৈতটা ভেঙে একেবারে অদ্বৈত দর্শনে পৌঁছতে পারলে সমস্যা থাকে না। এর একটা হালের নাম রয়েছে এথিকাল পলিঅ্যামরি। পর ও বরের দ্বন্দ্ধ বা বলা ভাল স্বকীয় ও পরকীয়র দ্ধন্দ্ব তা বলে সহজে যেতে চায় না, তাই ওগো বধু সুন্দরীতে নায়কের মুখে দেখি গানের পংক্তি – একটা নিয়েই গলদঘর্ম দুই পাটেতে নেইকো লোভ… যদিও বাস্তব জীবনে তিনি উত্তম পলিগ্যামাস এবং পলি-অ্যামরাস কিন্তু তাঁর গলদঘর্ম অবস্থার কথা আমরা কিই-বা জানি। পুরুষের এ দ্বন্দ্ব যায় না বাঙালী জীবনে তার একখান দারুণ উদাহরণ আছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে। এক দম্পতির সঙ্গে যখন একজন পুরুষের আলাপ হচ্ছে তখন সেই পর নারী-পুরুষের সাবলীল মেলামেশায় বর-পুরুষটির মুখ ভার। এটুকুই গল্পটির মজা নয়, গল্পের মজা উলোটপুরানে, একই পুরুষটি যখন তার বউয়ের সঙ্গে, এবং সেই আগের বর-পুরুষটির সঙ্গে মোলাকাত হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে সাবলীল পুরুষ ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে উঠছে। এইটাই সমস্যার মূল। তাই ওই আমার মাল না ভেবে মানুষ হিসেবে একে অপরকে দেখলে পরকীয় স্বকীয়র বাইনারি থাকে না। কঠিন? উদাহরণ রয়েছে দেশ-বিদেশে প্রচুর, যেমন ধরুন হেনরি মিলার তার স্ত্রী জুন মিলার ও প্রেমিকা অন্যাইস নিন-এর সম্পর্ক। উভকামী অ্যানাইস প্রেমে পড়েছিলেন ও প্রেম করেছিলেন দু-জনের সঙ্গেই। চুলোচুলির খবর পাওয়া যায়নি। সেই জন্যই বোধহয় একটু কম খবর রাখি কারণ এতে মশলা নেই, কেচ্ছা নেই। পিকাসোর জন্য তার দুই প্রেমিকার পিকাসোর সামনে চুলোচুলির খবর যতটা মুখে রোচে ততটা রোচে না সম্মতিক্রমে হলে। এই ‘সম্মতিক্রমে’ শব্দটাতেই পৌঁছতে চাইছি, আগেই বলেছি হালের ভাষায় যাকে বলে এথিকাল পলিঅ্যামরি। একবার এই জায়গায় পোঁছতে পারলে পর ও বরের নিষিদ্ধতা ও অসম্মানের দিকগুলো ঝরে গিয়ে সুন্দর ও শোভন হয়ে ওঠে, রাতের বেলায় মেয়েদের ইনবক্স ভরে ওঠে না অযাচিত আবদারে আর আমি বউয়ের হাতে নিপীড়িত তাই তোমায় চাইগোর কুমির-কান্নায়। শক্ত ব্যাপার? হ্যাঁ বটেই তো, সমাজে যা কিছু ভাল ও সুন্দর তাতে পৌঁছনো শক্ত। কিন্তু অসম্ভব নয়। উদাহরণ বিলিতি দিলাম বলে ভাবতে পারেন এমন আমাদের দেশে হতে পারে না? একটা মজার উদাহরণ দিই। মধু বসু ছিলেন বাংলা সিনেমার প্রথম যুগের চিত্র-পরিচালক, তাঁর স্ত্রী ডাকসাইটে নায়িকা সাধনা বসু। তাঁদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, ডিভোর্স। তারপর তারা আবার একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন। কী বলবেন মধু বসুকে, বর না পর?
শুভদীপ মৈত্র
খুব ভালো লাগলো পড়ে… The other side of the moon type…
ধন্যবাদ
শুভদীপ মৈত্র পরপুরুষ বরপুরুষ কনসেপ্ট টি নিয়ে নানান দিক থেকে আলোচনা করেছেন। ভাল লাগল পড়তে। উপভোগ্য।
ধন্যবাদ
পুরুষের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করলেন শুধু নয়, বর বা পরের tag টা খুলে ফেলার চেষ্টাও করলেন।
যৌনতার সঙ্গে যদি সৌন্দর্যচেতনা না মেশে তা বিকৃতিতেই পর্যবসিত হয়, তাঁর ভাষায় লোচ্চামি।—–
হাজার কথার সারাৎসার।