ওঁদের যেমন দেখছি পর্ব – ৬

ওঁদের যেমন দেখছি পর্ব – ৬

অজন্তা সিনহা

 

সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে–বচনখানি শুনলেই পিত্তি জ্বলে ওঠে। এ কেমন কথা বাপু ! পুরুষের তাহলে সবেতেই ছাড় ! আমার এই মানসিকতা যাঁর সংস্পর্শে এসে বিপুল ধাক্কা খায়, যাঁকে আক্ষরিক অর্থেই এই প্রবাদকে সত্যে পরিণত করতে দেখেছিলাম, তাঁর কথাই বলবো আজ। বলে রাখা ভালো, ইনি আমার মা-ঠাকুমার আমলের মোটেই নন। বয়সে আমার থেকে বেশ খানিকটা ছোটই হবেন। আমি যে সময় ও যে অঞ্চল বা পরিবেশের কথা বলছি, সেখানে মেয়েরা রীতিমতো স্বনির্ভর। ঘরে-বাইরে ছুটছেন তাঁরা, ঘরের কাজ ও পেশা দুইই সামলাচ্ছেন। কিন্তু নিছক সংসারকে ঘিরেই আবর্তিত নয় তাঁদের জীবন। সেই সময়ের পক্ষে খুব বেশি মাত্রায় ব্যতিক্রমী এক নারীকে দেখে শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছিলাম। 

 

তখন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বারুইপুরে থাকি।  বেশিরভাগ সময় মহিলা কামরাতেই যাই-আসি। যাতায়াতের পথে চেনা, পরিচয়, সম্পর্ক। দু’একজনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয় ধীরে ধীরে। তেমনই একজন, আজ এত বছর পর নাম আর মনে নেই, ধরে নেওয়া যাক সন্ধ্যা, আজ তারই গল্প বলবো। বয়সে ছোট বলে আমাকে সে দিদি বলে ডাকতো। শান্ত ও নরম স্বভাব। একেবারে ঘরোয়া। স্বামী খুব অল্প বয়সে কঠিন অসুখে মারা যাওয়ার পর তাঁরই অফিসে চাকরি করছে সে। এক মেয়ে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতেই ছিল বরাবর। মেয়ে সামান্য বড় হবার পর বিয়েও দিয়ে ফেলেছে। মেয়েও স্বামী-বাচ্চা নিয়ে সুখে আছে। সন্ধ্যার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও মোটের ওপর ভালোই। 

 

সবাই এত ভালো। তবে খারাপটা কে ?– মজা করে এই কথাটা বললেই সন্ধ্যা খুব হাসতো। চিন্তাভাবনা ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আমরা দুজনে একেবারে বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। আমি স্বাধীনচেতা, সংসার ছেড়ে বহুদিন একার জীবন বেছে নিয়েছি। পেশায় সাংবাদিক। আমি সর্ব অর্থেই স্বনির্ভর। সে স্বামীহারা হয়েও সংসারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। তার চাকরি করাও সংসারের জন্যই। শ্বশুর-শাশুড়ি মনেপ্রাণে শুধু নয়, জীবনযাপনেও তার ওপর নির্ভরশীল। বাড়িতে দেওর-জা, ননদ ইত্যাদি যারা আছে, তারা সকলেই সন্ধ্যার অনুরাগী। ভালোমন্দ যেটাই হোক, তার পরামর্শেই সবাই চলে। 

 

প্রতিদিন যেতে-আসতে সন্ধ্যার জীবনকথা শুনতাম। আপ্লুত হতাম। শ্রদ্ধাও করতাম। কত কম বয়সে জীবনের সব ইচ্ছে, আকাঙ্খার দরজা বন্ধ করে বসে আছে। কিন্তু মনের কোথাও কোনও অভিযোগ নেই। কারওর সম্পর্কে নিন্দা নেই। রাগ নেই। আক্ষেপ তো মোটেই নেই।

“কি করে এত তৃপ্ত থাকো তুমি ? সেই কবে থেকে জোয়াল কাঁধে নিয়ে চলেছ, ক্লান্ত লাগে না ?” 

আমার এই কথায় সন্ধ্যার একটাই জবাব, “এতগুলো মানুষ আমার মুখের দিকে চেয়ে বাঁচে দিদি। নিজের কথা মনেই থাকে না !” 

শুধু স্বামীর কথা বলার সময় উদাস হয়ে যেত তার চোখদুটো, “মানুষটার বড্ড বাঁচার ইচ্ছে ছিল গো। শেষের দিকে যখন বুঝতে পারছে আর থাকবে না, তখন একেবারে ছটফট করতো। খুব চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারলাম না ধরে রাখতে।”

 

মাঝে মাঝে তাদের ক্ষণস্থায়ী সুখী দাম্পত্যের গল্পও শুনতাম। সন্ধ্যার জন্য সে স্মৃতি একই সঙ্গে মধুর ও বেদনাময়। তবু, স্মৃতিচারণ করতো সে। আর সব কথার শেষে, “তুমি আমার আগের জন্মে সত্যি দিদি ছিলে গো। এতসব আজ অবধি কাউকে বলিনি আমি।” আমি মজা করে বলতাম, “কোন জন্মে আবার কি ? আমি ওসব মানি না। সবকিছু এইজন্মেই।” আমার বিপরীত যুক্তিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল সে। তাল মিলিয়ে মজাও করতো। ততদিনে আমিও এটা বুঝে গেছি, রেলপথের ওইটুকু সময়ই তার নিজের, যা আমার সঙ্গে ভাগ করে এক নির্মল আনন্দ পেত স্বামীহারা এই নারী। সন্ধ্যার একাকী অন্তরজগতের খবর শুধু আমিই রাখতাম।  

 

এইসবের মধ্যেই একদিন, তার বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালো সন্ধ্যা। উপলক্ষ রান্না পুজো। সাফ কথা, “এর আগে অনেকবার বলেছি দিদি, যাওনি তুমি। এবার কোনও কথা শুনবো না।”  তার বাড়িতে না যাওয়ার বিশেষ যে কোনও কারণ ছিল, তা নয়। আমাদের পেশায় ছুটিছাটা বড় কম। সপ্তাহে একটাই ছুটির দিন। বড্ড আলস্য লাগতো সেই দিনটায়। ঘরের কাজকর্মও থাকতো। যাই হোক এবারটা যেতেই হবে। রান্না পুজোর পান্তা প্রসাদের লোভও ছিল। অগত্যা সম্মতি জানালাম। কোনওভাবে অফিস থেকে রেহাইয়ের একটা ব্যবস্থা হয়েছিল সেদিন। ছুটি ছিল, না ছুটি নিলাম, আজ আর মনে নেই। সকাল সকাল স্নান করে বেরিয়ে পড়লাম। জলখাবার তার বাড়িতে গিয়েই খাব, কথা দিতে হয়েছিল। অতএব শুধু চা-বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়া। 

 

আমি বারুইপুরের মদারাট বলে একটা জায়গায় থাকতাম। ওর এলাকার নাম ভুলে গেছি। এটা মনে আছে পদ্মপুকুর থেকে আরও একঘন্টা অটোযাত্রা। সে খুব সুন্দর করে ঠিকানা ও পথনির্দেশ লিখে দিয়েছিল। সেসময় সেলফোন নেই। ফলে ওই পথনির্দেশ ব্যাপারটা খুবই জরুরি তখন। পদ্মপুকুর থেকে অটোতে উঠলাম। কিছুদূর যাওয়ার পরই দৃশ্যপট  বদলে গেল। দুপাশে ধানক্ষেত। সবুজে সবুজ একেবারে। মাঝে মাঝে পুকুর, ডোবা। তাতে পদ্ম, শাপলা দল মেলেছে। প্রাচীন বট, মন্দির, মসজিদ, গোশালা, ঝোপঝাড় এসব দুদিকে রেখে পথ গিয়েছে একেবেঁকে। যেতে যেতে এক সময় একা আমি। অন্য যাত্রীরা একে একে নেমে গেছেন। 

 

অটো ড্রাইভার শুরুতেই বলেছিল, “ভাববেন না দিদি। আপনার ওই বোনের বাড়ি খুব ভালো চিনি আমি। আমার নিজেরই গ্রাম। একেবারে জায়গামতো নামিয়ে দেব।” সেটা দেয়ও সে। অটো থেকে নামতেই  ছুটে এল সন্ধ্যা। খুশি আর লুকোতে পারে না। জড়িয়ে ধরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায় আমায়। যাকে বলে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট। এর মধ্যে এক বিপত্তি, অটো ড্রাইভার কিছুতেই ভাড়া নেবে না। নাকি, আমি তার গ্রামে এসেছি। সব ওই মেয়ের কল্যাণে বুঝতে অসুবিধা হয় না। গ্রামেও যথেষ্ট জনপ্রিয় সন্ধ্যা। শেষে কথা হয়, ওই ছেলেটিই রাতে পুজো হয়ে যাবার পর নিয়ে যাবে আমাকে। তখন যা দেবার একসঙ্গে দেওয়া যাবে।

 

অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো একতলা ইটের বাড়ি। সামনে পিছনে প্রচুর খালি জায়গা। গাছপালা, পুকুরও আছে। ভিতরের একটি ঘরে সন্ধ্যা আমাকে নিয়ে গিয়ে বসানো মাত্র, সবাই আমাকে দেখতে চলে এল। সবাই বলতে সবাই, ওর বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই পর্যন্ত। একে একে পরিচয়ের পালা সাঙ্গ হয়। এবার জলখাবার। সে একেবারে মহা উৎসবের আয়োজন! প্রথমে চা-বিস্কুট। তারপর কাঁসার থালায় সাজিয়ে ফুলকো লুচি। সে একেবারে টইটুম্বুর। সঙ্গে আলুর তরকারি। “আরে, এত কি করে খাব ?” বলতেই সন্ধ্যার জবাব, “ওসব শুনবো না। তুমি লুচি ভালোবাসো, কতবার বলেছ আমায়। সময় পাও না। একার জন্য বানাতে ইচ্ছে করে না। আজ প্রাণ ভরে লুচি খাও।” আরে এ পাগলকে তো কিছু বলাও মুশকিল। ভালো লাগে। কিন্তু এত কি খাওয়া যায় ? যাই হোক, কিছু টানাহ্যাঁচড়ার পর লুচি খাওয়ার পর্ব মিটলো। 

 

মিটলো কী ? সন্ধ্যার মতোই তার বাড়ির লোকজন। অতিথি আপ্যায়নে তাদের উৎসাহে ঘাটতির কোনও লক্ষণই নেই। এর মধ্যে স্বামী-বাচ্চা নিয়ে সন্ধ্যার মেয়েও হাজির। পাগলামিতে সেও কম যায় না। খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, গ্রাম দেখা, গান গেয়ে শোনানো এসব পর্ব শেষ হতে হতে রাত নামে। বাড়ি ভর্তি লোক। সবাই ব্যস্ত নানা কাজে। কিন্তু আমাকে একটা মুহূর্তের জন্যও একা ছাড়ে না কেউ। যদি আমার খারাপ লাগে। সে তো খুব ভালো। কিন্তু বাড়ি ফিরতে হবে তো ! রাত বাড়ছে। অচেনা জায়গা। কে শোনে কার কথা ! পুজো শেষ হবে, প্রসাদ পাব, তারপর ফেরা।

 

পুজোআচ্চায় অনুরাগ আছে, এমনটা আমার অতি বড় শত্রুও বলবে না। কিন্তু সেই রাত, সেই পরিবেশ, ওই পরিবারের আন্তরিকতা আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। যে ঘরে পুজো হচ্ছে, সেখানেই সবার সঙ্গে বসে আমিও পুজো দেখলাম। খুব যে খারাপ লাগলো, সেটা বলতে পারবো না। কোনও এক সময় এই পর্বও মিটলো। ক্ষণিক বিরতি, পুজো পরবর্তী আচার ইত্যাদির জন্য। আমি বাইরের ঘরে এলাম। একটু বসার পরই আবার ভিতরে ডাক। প্রসাদ পাব। রীতিমতো পাত পেড়ে খাওয়া। পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ ভাজা, চিংড়ি মাছ ভাজা, আরও নানাপদের ভাজা, পাঁচমেশালি সবজি, টক, মিষ্টি,পায়েস। 

 

খেয়ে উঠতে ঘড়ির কাঁটা দশটা পার করে। কি ভাগ্য, সেবারে তিথি একটু আগে আগে পড়েছিল। অন্যান্যবার নাকি মাঝরাত পার হয়ে যায়। ততক্ষণে অটো চলে এসেছে আমায় নিতে। সন্ধ্যা তাকে নির্দেশ দেয়, আমাকে যেন বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়। বিদায় জানাতেও হাজির বাড়ির সবাই। মায় আগত আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত। অটো চলছে একই পথে। গ্রামে দশটা বাজলেই রাত গভীর। ঝিঁঝির ডাক ছাড়া শুনশান সব। জোনাকিরা উড়ছে। ভাদ্রমাসের শেষ রাত। সারাদিনের গুমোটের পর বাতাসে ঠান্ডা আমেজ। হালকা চাঁদের আলোয় মায়াময় পথঘাট। তারারা মিটমিট করে জ্বলে। গাছের ফাঁকফোকড় দিয়ে সেই সামান্য আলোর রেখা উঁকি মারে।

 

কোথাও কোনও শব্দ নেই। অন্ধকারে সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়। এদিকওদিক গর্ত ইত্যাদিও আছে। অতএব ড্রাইভারের পুরো মনোযোগ ওদিকেই। আমার হৃদয় পূর্ণ অনাবিল আনন্দে। কত উপলক্ষে কত বাড়িতেই না গেছি। আদর আপ্যায়নও পেয়েছি। কিন্তু আজকের প্রাপ্তি ছাপিয়ে গেল সব। এক সাধারণ গ্রাম্য গৃহবধূ, পরিস্থিতির কারণে কর্মরত হলেও পুরোমাত্রায় ঘরোয়া এক নারী। কোথাও কোনও দেখানেপনা নেই। কি অপরূপ এক মায়ায় সে বেঁধে রেখেছে তার পরিবারকে। বেঁধেছে আমাকেও। বারুইপুর থেকে কলকাতা, সেখান থেকে আর একটু দূরের উত্তরবঙ্গ–বদলে যাওয়া জীবনে সন্ধ্যার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম বাস্তব কারণেই। কিন্তু ভুলিনি তাকে। আর সেই রান্না পুজো–দিনটা অনন্তকালের সম্পর্কের প্রতীক হয়ে রয়েছে। থাকবে।

অজন্তা সিনহা

Nila Banerjee

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *