চার পর্বের গল্প/ মহেঞ্জোদারো সুতা/ পর্ব – তিন

মহেঞ্জোদারো সুতা
প্রতিভা সরকার
হরাপ্পা সভ্যতায় মৃত মানুষকে সমাধিস্থ করবার অনেক রকমফের ছিল, রাজেশ ভালো করেই জানে। ঢোলাভিরাতে খননের সময় নানা কংকাল নানা ভাবে পাওয়া গেছে। বাবা জয়মলের কাছে সেসব শুনে শুনেই তার বড় হওয়া। কেউ নাকি বাঁ কাতে শুয়ে ছিল, কেউ চিত হয়ে। কারও আবার মাটির হাঁড়িতে রাখা শুধু হাড়গোড়। কারও সমাধি চৌকো, কারও গোল। কাউকে সমাধিস্থ করবার পর ইট আর কাঠ গেঁথে বুজিয়ে দেওয়া হত। কেন এতো রকম ভাবতে গিয়ে রাজেশের মনে হয়েছে জাত পাত, স্ট্যাটাসের বিভেদই এর জন্য দায়ী। রাজা রাজড়ারা আস্ত আস্ত শুয়ে থাকতেন মরার পরও, মাঝারিদের খালি হাড়গোড় সংরক্ষণ করা হত, আর ডাউনটাউনে যত খেটে খাওয়া মানুষের বাস, তারা অক্কা পেলে হাতে পায়ে পাথর বেঁধে নদীতে ছুঁড়ে ফেলা হত উঁচু প্রাকার থেকে। তার মানে যত কংকাল পাওয়া গেছে, সবই বোধহয় অভিজাত সম্প্রদায়ের।
এই ভাবনার মাঝে তারা পৌঁছে যায় সমাধিক্ষেত্রে। ছোট কুলগাছ আর কাঁটা বাবলায় ভর্তি জায়গাটা। পায়ের নীচে অজস্র ভাঙা পাথর, আর হলদে মরা ঘাস ছেয়ে আছে। যে সব সমাধি খনন করে আবার বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের একদিকে লম্বা মতো একটা পাথর পুঁতে দেওয়া। হরাপ্পান প্রথা অনুযায়ী যেদিকে মৃতের মাথা থাকত সেদিকে ঐরকম একটা চিনহ রাখা আবশ্যিক।
একটা ছোট্ট মেয়ের মতো রাকুল চঞ্চল পায়ে ছোটাছুটি করতে গিয়ে একটা পাথরে হোচট খেল। তারপর পাথরটার দিকে তাকিয়ে উফফ বলে আঁতকে উঠল। রাজেশ ভালো করে চেয়ে দেখে বাতাসের কেরামতিতে সেটাকে দেখতে একদম একটা করোটির মতো। পাথরে পাশাপাশি গর্ত হয়ে গিয়ে তৈরি হয়েছে দুটি গোলাকৃতি চোখ, তাদের সঙ্গে সম দূরত্বে নীচের দিকে আর একটি গর্ত, যেন করোটির হাঁ মুখ। ভয় পাবার মতোই!
তবে রাকুল সহজে দমবার মেয়ে নয় তো। অনেকটা জায়গা জুড়ে তার উচ্ছল ছুটোছুটি চলতে থাকল। কখনও রাজেশকে আঙুল দিয়ে দেখায়,এটা আমার বাবার সমাধি, এটা আমার মায়ের। আবার পরক্ষণেই বলে, না না ভুল হচ্ছে। ঐ ঈশান কোণেরটাই আমার বাবার, এটা নয়। এটাতে আছে আমার ভাই। হঠাত তার জুতোর চাপে একটা পাথর ছিটকে গিয়ে পড়ে দূরের অদ্ভুত দেখতে একটা গাছের পায়ের কাছে। ভয় পেয়ে কী একটা পাখি যেন উড়ে যায় গাছটা থেকে। রাতচরা কোনো পাখি হবে হয়তো। দিনের বেলা আত্মগোপন করে বসে ছিল, এখন ভয় পেয়ে ক্যাঁ ক্যাঁ করে উড়ে গেল। খুব বড় নয়, কিন্তু ডাকটা কীরকম আর্তনাদের মতো। শুনলে কান্না পায়।
পাখিটা ডেকে ওঠবার পর থেকেই রাকুল কেমন গম্ভীর হয়ে যায়। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় গাছটার দিকে। তার ব্যবহারে অনেক্ক্ষণ থেকেই তিতিবিরক্ত হয়েছিল রাজেশ, এখন সে এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবছিল কখন এই নাটকের শেষ হবে। সে আবার অন্য ট্যুরিস্টদের স্বাভাবিকভাবে ঘুরিয়ে দেখাবে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগেকার নগরের ধ্বংসস্তূপ। সমঝদার কাউকে পেলে প্রাণ ঢেলে বোঝাবে, অন্যদের বোকা বোকা প্রশ্নের দায়সারা জবাব দেবে, বিকট হাহা হোহো-তে ভেতরে ভেতরে বেজায় খেপে যাবে, কেউ সমাধি স্থলে আসতে চাইলে আবার নিয়ে আসবে আড়াই কিলোমিটার দূরে এই পশ্চিম প্রান্তে। বাঁচোয়া এই যে, বছরে ৮০/৯০ হাজার ট্যুরিস্ট আসে, কিন্তু এতদূর সমাধিক্ষেত্রে আসবার লোক কোটিকে গুটিক। আর রাজেশ এতদিনে এমন কাউকে সে পায়নি যে নিজেকে এখানকার প্রাচীন অধিবাসী বলে দাবী করেছে। রাকুল ম্যাডামের কেস তার জীবনে এই প্রথম, বোধহয় এই শেষ।
হঠাৎ রাকুল গাছটার তলে বসে পড়ে পকেট থেকে একটা ছোট ছুরি বার করে পাথুরে মাটিতে বার বার আঘাত করতে থাকে। হাঁ হাঁ করে ছুটে আসে রাজেশ, করছেন কী ম্যাডাম! এখানে সবরকমের খোঁড়াখুঁড়ি বারণ, আপনি জানেন না!
মুঠোর ভেতর একটা কিছু নিয়ে রাকুল উঠে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি অস্বাভাবিক, যেন অনেক দূরের কিছু দেখছে সে, এই সমাধিস্থল, পাথর, বেঁটে কাঁটা গাছ, আরও দূরে সিটাডেল, মিডল টাউন, লোয়ার টাউন, বৃষ্টির জল ধরে রাখার বিশাল ব্যবস্থা, পয়ঃপ্রণালি, সব ছাড়িয়ে কচ্ছ উপসাগরের ওপর দিয়ে উড়াল দিয়েছে সেই দৃষ্টি। ভূতে পাওয়া গলায় সে রাজেশকে ডাকে, দ্যাখো মেন্ড্রা, যা খুঁজছিলাম কুড়িয়ে পেয়েছি। আমার মনে ছিল অগভীর মাটিতেই আমি এটা পুঁতে রেখেছিলাম। এবং রাজ পুরোহিত বলেছিলেন নিশ্চিন্তে চলে যেতে, কারণ হাজার হাজার বছর পরে হলেও এক নিশাচর পাখি আমায় বলে দেবে আমার সবচেয়ে ভালবাসার এই জিনিসটির কথা।
আবার শুরু হল সেই এক ভ্যানতারা! বিরক্ত রাজেশ এগিয়ে যায় কী পেল রাকুল তা দেখার জন্য। এবং সবিস্ময়ে দ্যাখে তার হাতের মুঠোয় একটি কালো লম্বা পাথরের টুকরো। তার হঠাত হাসি পেয়ে যায়। এটা কী!! সাত রাজার ধন এক মাণিক, নাকি রূপকথার সাপের মাথার মণি। তাকে হাসতে দেখে ফুঁসে ওঠে রাকুল, মেন্ড্রা, তুমি হাসছ!! নিজের বন্ধুর স্মৃতিকে এইভাবে অপমান করছ!
হাসতে হাসতে রাজেশ বলে, বন্ধু! কে আমার বন্ধু সেটা পরে শুনছি। কিন্তু জিনিসটা কী সেইটা তো বলুন। ওরকম পাথর এই সাইটে হাজার হাজার ছড়িয়ে আছে।
পাথর নয়, রাকুল প্রায় চিৎকার করে ওঠে, এটি একটি কর্ণেলিয়ান বিড। আমাকে এই বিডের মালা তার প্রেমের নিদর্শন স্বরূপ উপহার দিয়েছিল তোমার বন্ধু জাকুস। তুমি সব ভুলে গেছ মেন্ড্রা? আমি একটি মাটির পাত্রে এই মালা লুকিয়ে রেখেছিলাম সমাধিক্ষেত্রে। কারণ জাকুসের সমস্ত স্মৃতি লোপাট করে দেবার আদেশ জারি করেছিলেন অভিজাত-প্রধান, মানে আমার পিতৃদেব। এইরকম নিখুঁত কর্ণেলিয়ান পুঁতি জাকুসের কর্মশালা ছাড়া আর কোথাও বানান হয় না এটা বাখিল নগরীর সবাই জানত। আমি পালিয়ে যাবার দিন তাড়াহুড়োয় তার দেওয়া এই শেষ উপহার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারিনি। এতদিন পরে খুঁজে পেয়েছি যখন এটা আমায় নিতে দাও। আর একটু খুঁড়লেই আমি পেয়ে যাব সেই মৃৎপাত্র আর মালার অন্য ছিন্ন অংশগুলি।
এবার রাজেশের মুখ শক্ত হয়ে ওঠে, দেখুন ম্যাডাম, আপনার কোনো কথাই আমি বুঝতে পারছি না। শুধু একটি কথা স্পষ্ট বলে দিতে চাই, এখান থেকে একটি পাথরের টুকরোও কুড়িয়ে নেওয়া বারণ। আমি থাকতে অন্তত আপনি সেটা পারবেন না।
এবার হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে রাকুল। দরদর করে বেরনো চোখের জলে তার গণ্ডদেশ ধুয়ে যাচ্ছে। কাতর কন্ঠে সে বলে, মেন্ড্রা এত নিষ্ঠুর হয়ো না প্লিজ। জাকুস ছিল তোমার প্রাণের বন্ধু। সবার চোখ এড়িয়ে আমাদের মোষে টানা গাড়িতে করে পরিখা পার করে দিয়েছিলে তুমিই। তুমি জানতে আমি অভিজাত কন্যা লোকা, আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছি আমার প্রেমিক পুঁতি কারখানার তরুণ প্রতিশ্রুতিবান প্রধান শিল্পী জাকুসকে। কিন্তু সিটাডেল আর ডাউন টাউনের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক তখন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তাই পরস্পরের সঙ্গে থাকতে চেয়ে আমরা পাড়ি দিয়েছিলাম বহুদূরের রাহিগান নগরীতে, যাকে সবাই এখন রাখিগঢ়ি বলে জানে।
সেখানে আমার পরিচয় কেউ জানবে না, তাই ঘর বাঁধার স্বপ্নও সফল হবে এইরকম ভেবেছিলাম আমরা দুই নির্বোধ তরুণ তরুণী। কিন্তু কী করে সেই দূর অঞ্চলেও ফাঁস হয়ে যায় আমাদের সত্য পরিচয়। রাহিগানের অভিজাত প্রধান আমাদের জন্য ধার্য করেন মৃত্যুদণ্ড। বিবাহরাত্রেই হানা দেয় তার সৈন্যেরা, টেনে নিয়ে যায় রাজপ্রাসাদে। রাজার গুপ্ত হত্যাকক্ষে মুগুরের ঘায়ে আমার চোখের সামনে হত্যা করে আমার জাকুসকে। তারপর আমাকে। তবু রাহিগান নৃপতির অসীম করুণা, মৃত্যুর ঠিক আগে আমার আকুল প্রার্থনা তিনি মঞ্জুর করেন জাকুস আর আমাকে একই সমাধিতে সমাহিত ক’রে।
গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে রাজেশের। এতো বানিয়ে কি কেউ বলতে পারে! হরপ্পা সভ্যতায় হাজার হাজার সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু যুগলের সমাধি খুবই অল্প। তার মধ্যে সবচেয়ে অবিকৃত দুটি কংকাল মিলেছে রাখিগঢ়িতে, একই আয়তাকার সমাধির ভেতরে। ডিএনএ টেস্ট করে দেখা গেছে সাড়ে ছ’ ফিটের লম্বা কঙ্কালটি পুরুষের। তার বুকের কাছে শুয়ে থাকা পাঁচ নয়ের কঙ্কালটি নারীর। তারা পরস্পরের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। পুরুষের একটি শুকিয়ে যাওয়া হাত নারীটির কাঁধের ওপর রাখা। যেন অভয় দিচ্ছে, বলছে, এই তো আমি আছি তোমার পাশে। এই কঙ্কাল যুগলকে নিয়ে দেশ বিদেশের পুরাতাত্বিক ও ঐতিহাসিক মহলে এখনও প্রচুর চর্চা চলছে। আরও বেশি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে ব্যাপারটা, কারণ দুই কংকালের করোটিতেই ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। মনে হয় যুগলকে মুগুরজাতীয় অস্ত্রের আঘাতে খুন করে একই সমাধিতে সমাহিত করা হয়েছিল। তবে রাকুলের এসব তথ্য ভালোমতো জ্ঞাত থাকবার কথা, কারণ পুরাতত্ত্ব এবং ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা মানুষের এসব একেবারেই অজানা নয়।
কান্নায় ভেঙে পড়া রাকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় বোধ করে রাজেশ। সে তো মনস্তাত্ত্বিক নয়, মানুষের মনের বৈকল্য তার কাছে অচেনা। বরং বেশি চেনা এই ইট ও পাথরের ধ্বংসাবশেষ। এর কাছেই তার দায়বদ্ধতা। পুরাতত্ত্ব বিভাগের ফরমান অনুযায়ী এখান থেকে কোনো ধ্বংসাবশেষ কেউ কুড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। এই ভদ্রমহিলা যদি সত্যিই মহেঞ্জোদারো হরপ্পা সভ্যতার কন্যা হয়ে থাকেন, তাহলেও নয়। সে বেশ কড়া গলায় বলল, হাত থেকে ওটা ফেলুন ম্যাডাম। আর খোঁড়াখুঁড়িও করবেন না।
রাকুল এবার উঠে আসে। তার চোখ কান্না মুছে ফেলে জ্বলন্ত উনুনের মতো দাউদাউ করছে। উত্তেজনায় বুক দ্রুত উঠছে নামছে। হাতের ছুরিটি বিপজ্জনক ভাবে দৃঢ় মুষ্টিতে ধরে রেখে সে রাজেশের এতো কাছে এসে দাঁড়ায় যে রাজেশের মনে হয় এই উন্মাদিনী হয়ত তাকে আজ হত্যা করবে। মরুভূমির বাতাস রাকুলের শরীরের সুগন্ধ পৌঁছে দেয় রাজেশের মস্তিষ্কের কোষে কোষে, এক মূহুর্তের জন্য তার মনে হয় রাকুল যা বলছে তাইই হয়ত ঠিক, অনেক যুগের ওপার থেকে ব্যর্থ প্রেম আর অকাল মৃত্যুর অভিশাপ নিয়ে যে নারী আজ তার মুখোমুখি, এখন মুম্বাইয়ের ধনাঢ্য পারসি পরিবারের কন্যা বা বধূ হলেও, আসলে সে মহেঞ্জোদারোর মেয়ে, একদা বাখিল নগরীর অভিজাততমা নারী পরমাসুন্দরী লোকা।
(ক্রমশ)
প্রতিভা সরকার
ভাল লাগল মহেঞ্জোদরো সুতা তৃতীয় পর্ব। ফিরে গেলাম ঐ জগতে।
বেশ ভালো লাগলো… শুভেচ্ছা অফুরন্ত…