বই-ভব-বই- কী

প্রেম ….এক অদেখা পরশমাণিক, এক অনঙ্গ আলো- যাকে নিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কবিতার লাইনটি একদা লিখেছিলেন পাবলো নেরুদা, –
” I want to do with you what spring does with the chrerry trees”- সেই প্রেম আজও তেমনই এক অথৈ বিস্ময়।এই গ্রহের অনন্তনিদাঘে এক টুকরো মেঘৈর্মেদুরম্বরম্। আজও প্রেম এক অনন্য মানসআশ্রয়।
আসলে “All the world loves the lover”! সেও কি নয় এক চিরকালের সত্যি? আর সেই প্রেমোপাখ্যান যদি হয় আমাদের এই চিরচেনা মহানগরীর আনাচকানাচ থেকে উঠে আসা দুটি চরিত্রের, যদি তারা প্রগাঢ় অভিসারে মুখোমুখি এসেও আবার দূরতম প্রতিসারী বিন্দুতে সরে যায় – তাহলে পাঠকের বুকের মধ্যে দীর্ঘ সেতু পেরিয়ে ছুটে যেতে থাকে মধ্যরাতের দ্রুতগামী ট্রেন,- কোন এক জানা গন্তব্যের অজানা ঠিকানায়।
সুনেত্রার লেখা ‘কফিশপের জানালা’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ছে। যখন মুখপুস্তিকায় সুনেত্রা একটা একটা করে কিস্তি দিতেন সাপ্তাহিক ভাবে, মাঝে মাঝেই অস্থির হতাম পরেরটার অপেক্ষায়। নির্ভেজাল রোম্যান্টিক উপন্যাস,- কিন্ত তার পরতে পরতে ছেয়ে আছে জেনারেশন জেডের আলোছায়াময় যাপনকথা – তার উন্মার্গী উচ্চাকাঙ্খা, বিধুর একাকীত্ব, নির্মায়িক আত্মপরতা – আবার তারই মধ্যে চারিয়ে থাকা এক প্রচ্ছন্ন জীবনাদর্শ,এক মূল্যবোধ সুগন্ধি ধূপের মত জানান দিয়েছে তার অস্তিত্ব। লেখক কুনাল বসু তাঁর একটি বইএর মুখবন্ধে লিখেছিলেন, – These are chronicles of memory n dreams born at crossroads of civilizations. They parade a cast of angels n demons rubbing shoulders wth those whose lives are never quite as ordinary as they seem. “কফিশপের জানালা”য় এই কথাগুলির গভীর প্রতিফলন দেখেছি।
উপন্যাসের নায়িকা “শাল পিয়াল আর সোনাঝুরি গাছের জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট গঞ্জের মেয়ে আভেরী”। আভেরী- এক কর্ণাটকী রাগিণী। শুদ্ধ কোমলে তার আলাপ, গহনে তার বিস্তার । নাগরিক ধূসরিমায় আবছা হয়ে পড়ে থাকা সেই বন্দিশটি তুলে নেয় সমদর্শী , মীড় দিয়ে নতুন করে সাজিয়ে তোলার জন্য। তবু… তবু ওই যে, ….না, কাহিনী বিশদে বলা যাবে না। সেটুকু রাখা থাক্ পাঠকের জন্য একান্ত।
সুনেত্রার কলম উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে তাঁর চরিত্রদের সাথে পাঠককেও- কলকাতা থেকে কখনও ক্যালিফোর্নিয়া, আবার শান্তিনিকেতন হয়ে দার্জিলিঙ, তারপর জাপান, এবং ফাইনালি নেদারল্যান্ডস!সেই বিশাল ক্যানভাসে কত রঙ আর রূপের সমাহার এই লেখায়! পরিবেশ আর প্রকৃতিও লেখিকার নিপুণ পর্যবেক্ষণে জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছে। মোলায়েম পশমের কারুকাজের মত করে প্রতিটি চরিত্র নিপুণ শৈলীতে বুনেছেন সুনেত্রা। সমদর্শী, আভেরী, সুনন্দ,পর্ণা, কাইতো,আমন, রিহানা, আডেন – সবাই যেন এক গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা । যেমন কাহিনীর ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট বদলেছে ,তেমন বদলেছে তার আর্থ-সামাজিক পটভূমিকা।অথচ সর্বত্রই এক মসৃণ অবতরণ পাঠকের মনোজগতকে বিব্রত হতে দেয় নি একটুও। বাড়তি এক মহার্ঘ উপহার আছে লেখাটিতে, তা হল চমৎকার সব শায়েরীর যথাযোগ্য ব্যবহার।
মেরি হর আহ্ কো ওয়াহ্ মিলা হ্যায় ইঁহা
কৌন কহেতা হ্যায় দর্দ বিকতা নেহি হ্যায়!
অথবা
কিসি কো না পানে সে জিন্দেগি খতম নেহি হোতি।
লেকিন কিসি কো পা কর খো দেনে সে কুছ বাকি নেই রহতা!!
সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের “শবনম”এর পর এত ভাল শায়রীর প্রয়োগ সচরাচর চোখে পড়ে নি।
প্রচ্ছদটি অতি নয়নসুখকর, তেমনই সুন্দর প্রকাশনার অন্য আঙ্গিকগুলি।
যদিও এই কাহিনী মিলনান্তক, তবু our sweetest songs are those that tell of saddest thoughts,- তাই হয়ত মনের গহনে অলক্ষ্যে থেকে গেছে কাইতো আর আডেন – রেখে গেছে তাদের চরণপাতের গভীর নৈঃশব্দ্য।
” মিলনা থা ইত্তেফাক বিছড়না নসিব থা,
উও ইতনা দূর হো গয়া যিতনা করীব থা ” – আলিঙ্গনের অদূরে থেকে গিয়েছে যার মানসী তার/তাদের জন্য কি আর একটি কাহিনীর উপবনে যাবেন সুনেত্রা? আডেন কি লিখবে এবার, – “Footfalls echo in the memory
Down the passage which we did not take
Towards the door we never opened
Into the rose garden …. into the rose garden “,যেমনটি প্রণয়িনী হেলকে এক প্রেমপত্রে লিখেছিলেন টি এস ইলিয়ট !
@ গৌরী মৃণাল

সুনেত্রার বইটা তো দারুণ লেগেছেই, গৌরীদির এই লেখাটা পুরো মুক্তোভাণ্ডার। কি দুর্দান্ত লেখা!
ভালোবাসা অফুরান
পুস্তক আলোচনাটিও ভারি মনোগ্রাহী। বইটি পড়ার ইচ্ছা জাগে।