লাপিজ লাজুলি পর্ব – ২

লাপিজ লাজুলি পর্ব – ২

লাপিজ লাজুলি 

সুনেত্রা সাধু

 

বেশ কয়েক বছর আগে মৈনাকদের অফিস পিকনিকে ডায়মন্ড হারবারে গিয়েছিল উৎসা। প্রায় সবাই এসেছিল স্ত্রী অথবা হবু স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে। আই টি কোম্পানীর পিকনিক, কাজেই পান এবং আহারের আয়োজন ছিল এলাহি। ঝাঁ চকচকে রিসর্ট জুড়ে উল্লাসের নানাবিধ উপকরণ দেখে উৎসা বেশ অবাক হয়েছিল। ‘মদের ফোয়ারা’ শব্দটা জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল চোখের সামনে….

 

মনে আছে সেদিন কোন একটা প্রজেক্টের সাকসেস পার্টিকে অফিস পিকনিকের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বোতলের পর বোতল শ্যাম্পেনের ফোয়ারা ছুটেছিল। টিমের লোকজন একে অপরের গলা জড়িয়ে তুমুল ভিজল। মৈনাক  সেদিন রেশমি নামের একটা মেয়ের কোমর জড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে নেচেছিল। আসলে নেশা করলে ভয়, কুন্ঠা ,অপরাধবোধ এসব বেশ সহজেই জয় করা যায়, মৈনাকও পেরেছিল। তাতে যে উৎসার খুব খারাপ লেগেছিল তা নয়, আসলে পুরো ব্যাপারটা ওর চোখে সার্কাস বলে মনে হচ্ছিল। যেন ট্র্যাপিজের খেলা চলছে, ব্যালেন্সটাই যেখানে শেষ কথা… এ ওর মন রাখছে, ও তাকে তেল দিচ্ছে, এই করে যতটা এগোনো যায় আর কী। আর অফিস যাদের এগোনোর রাস্তাটাই বন্ধ করে দিয়েছে তারা গ্যালন গ্যালন মদ আর কাবাব গিলে সোফায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। অজয়দা, ঋদ্ধিদা আর শুভঙ্করদা সেই দলের মানুষ। মৈনাক ছিল বসেদের নেকনজরে, ওর চাপটা যে বাকী তিনজনের থেকে অনেকটা বেশি সেটা উৎসা বুঝত। শ্রমণাদি মৈনাকের দ্রুত উন্নতি নিয়ে মাঝে মাঝেই খোঁটা দিত , উৎসা গায়ে মাখত না।

 

ওই পিকনিকের দিন  শ্রমণাকে এক অন্য রূপে দেখেছিল উৎসা। যে মানুষটার গায়ে সর্বদা সতীপনার খোলস আঁটা থাকে  সে পর্যন্ত তিন পেগ মদ খেয়ে গায়ের আঁচল লুটিয়ে তিনগুণ বকতে শুরু করেছিল। অজয়দা জড়িয়ে জড়িয়ে বলেছিল – 

 

কুত্তার পেটে যেমন ঘি সহ্য হয় না, তেমন শ্রমণার পেটেও মাল সহ্য হয় না। কোন শালা এই মহিলাকে মর্ডান হবার দিব্যি দিয়েছিল কে জানে! 

 

 নিজের স্ত্রীকে নিয়ে জনসমক্ষে এমন রসিকতা পছন্দ হয়নি  উৎসার, সেখান থেকে সরে এসে মিসেস শ্রীনিবাসনের পাশে বসেছিল। ভদ্রমহিলা বিগত দুঘন্টা ধরে হাতের গ্লাসটা একই ভাবে ধরে ছিলেন। এক সিপ খেয়েছিলেন কিনা সন্দেহ…উৎসাকে খালি হাতে বসতে দেখে ড্রিঙ্কস অফার করেছিলেন। বেয়ারা হাজির হয়েছিল নানা মাপের নানা রঙের গ্লাস নিয়ে। একটা সরু লম্বা গ্লাস দেখিয়ে বলেছিলেন এটা নাও ; ভদকা, টমাটো, জিঞ্জার আর লাইমের ককটেল, আশা করি তোমার ভালো লাগবে। সত্যি ভালো লেগেছিল। ওনার সঙ্গে টুকটাক গল্প করতে করতে পানীয়ে চুমুক দিচ্ছিল উৎসা, একটা হালকা নেশা ছড়িয়ে পড়ছিল মগজের কোষে কোষে। শ্রমণা দূর থেকে উৎসাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলেছিল,

শেষমেশ তবে গেলাস ধরলি ? বেশ করেছিস ,বিনা পয়সার মাল ছাড়বি কেন? খা খা।

 

শুনে মিসেস শ্রীনিবাসন বলেছিলেন, 

এসব সাবস্ট্যান্ডার্ড মহিলাদের সঙ্গে মেশো কেন? এদের ওই দামী চাকরীটাই আছে, এটিকেটের ভাঁড়ার শূণ্য……                                                                                                             তোমার একটা আলাদা কোয়ালিটি আছে উৎসা, একটা অভিজাত ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। ক্লাব জয়েন করো। নিজেকে আপডেটেড রাখো। যদি ভেবে থাকো তোমার স্বামী তোমাকে সময় দেবে তাহলে সেটা সম্পূর্ণ ভুল। নিজের জন্য বাঁচতে শেখো……

 

তারপর যতদিন মিসেস শ্রীনিবাসন কলকাতায় ছিলেন ততদিন উৎসা বহুবার ক্লাবে গিয়েছে। চ্যারিটি করেছে, নানা পার্টি অ্যাটেন্ড করেছে, মদিরা পান করেছে কিন্তু ওই অফিস পিকনিকের মতো আরামের নেশা আর কখনো হয়নি। আজ অনেকদিন পরে বিদেশি ছেলেটার নীল চোখের দিকে তাকিয়ে  সেই নেশা নেশা ভাবটা ফিরে এল। বাগান পেরিয়ে , লাউঞ্জ পেরিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিজের রুমে ফিরে গেল উৎসা। অন্বেষা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ফোন করছিল, উৎসা দেখেও দেখতে পেল না। মাথার ভিতর কেবল একটাই শব্দ পাক খাচ্ছে, ‘লাপিজ লাজুলি’।

 

রামকুন্ড রিসর্টের ঘর গুলো বেখাপ্পা রকমের বড়। সিলিং ছোঁয়া জানলা দিয়ে আসা আলোয় ঘর ভেসে যায়। বারান্দায় বসলে নজরে আসে গাছে ঢাকা সবুজ পাহাড় আর উচ্ছল দুই নদী। উৎসা এই দুদিন বারান্দায় অনেকটা সময় কাটিয়েছে। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রাতের দেবপ্রয়াগকে দেখেছে। জানলার পাশেই খাট, শুয়ে শুয়েই তারাভরা আকাশ দেখা যায়। 

ঘরের অন্য প্রান্তে ওয়ার্ড্রোব, চা কফির ব্যবস্থা আর ওয়াশরুম। দুটো প্রান্তকে জুড়ে রেখেছে একটা সোফা আর দেয়ালে ঝোলানো টিভি। কয়েক ঘন্টা আগেও এই ঘর উৎসাকে গিলে খেতে আসছিল অথচ ঠিক এই মুহুর্তে ঘরের প্রশস্ততা ওর মনে বুনে দিল এক খোলা আকাশের ছবি । একরকম উড়তে উড়তে এসে বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিল। ‘বিছানা’ শব্দটাতে কেমন যেন নিষিদ্ধ গন্ধ আছে। উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশটা আঁকড়ে ধরল ঊৎসা। শরীরটা নিজের বশে নেই। বালিশে নাক ঠেকিয়ে বুক ভরে গন্ধ নিল। নিজের শ্যাম্পুর গন্ধ পেল। শ্যাম্পুর কথা মনে পড়তেই উঠে এসে ড্রেসিং টেবলটার সামনে চুল খুলে বসল। ভালো করে ধুতে হবে , চুলটা অনুজ্জ্বল দেখাচ্ছে যেন। এই ‘শ্যাম্পু’ শব্দটাই উৎসাকে একটা দিনের কথা ঝপ করে মনে পড়িয়ে দিল। সে খেয়াল করে দেখেছে শব্দের সঙ্গে ঘটনার ছবি অদ্ভুত ভাবে জুড়ে থাকে। যেন এক একটা বিশেষ শব্দ হল এক একটা ফাইল। শব্দের সঙ্গে মেলানো ঘটনাগুলো যেখানে নিপুন ভাবে সাজানো। সেরকম অসংখ্য ফাইলে মগজের তাক ভর্তি। উৎসা শ্যাম্পুর ফাইলটা খুলতেই, মগজে নড়াচড়া করে উঠল সেই দিনের ছবি। 

 

 তখন মৈনাক মারা গিয়েছে দিন পাঁচেক হয়েছে, শৌনক দাহ কার্য সারার পর অফিস সংক্রান্ত কাজে ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিল। ওর বউ লারা সন্তান সম্ভবা, সে ইন্ডিয়া আসতে পারেনি। কাজের লোক ছাড়া উৎসার পাশে সেদিন আর কেউ ছিল না। সেকথা শুনে শ্রমণা, মধুরা আর অন্বেষা একটা গোটা দিন ওর সঙ্গে কাটিয়েছিল। ফ্ল্যাটে দুটো কাজের লোক সবসময় থাকে, তাই রান্না খাওয়া নিয়ে ভাবতে হয়নি। ওরা এসেছিল সকাল সকাল।  সদ্য স্নান সেরে এসে চুল আঁচড়াচ্ছিল উৎসা। মধুরা ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলেছিল,

 স্বামী মারা গেছে পাঁচদিন হয়নি এর মধ্যে চুলে শ্যাম্পু করে স্নান করলি? আবার মাথায় চিরুনি দিচ্ছিস! এসব করতে নেই কেউ বলে দেয় নি?

 

নোংরা চুল নিয়ে আমি থাকতে পারি না মধুরাদি। মাথা ধরে যায়। 

 

সবেরই একটা নিয়ম থাকে, আধুনিকতার দোহাই দিয়ে সব বিসর্জন দেওয়া যায় না, বলেছিল শ্রমণা।

 

অনেক লম্বা চুল যে, জট পড়ে যায়। উৎসা পালটা যুক্তি সাজিয়েছিল।

 

আজকাল এসব কেউ মানে  না। কিন্তু এই কটা দিন………” অন্বেষা কথাটা শেষ করেনি।

 

অপরাধবোধে  হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিল উৎসা। দলটা বুঝেছিল বাড়াবাড়ি হয়েছে। ওরা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করেছিল। উৎসা মানিয়ে নিয়েছিল, তারপর এই নিয়ে আর কোনো কথা হয়নি, শুধু মানুষগুলোকে একটু একটু করে চিনতে শিখেছিল।

 

ভাবনা ঝেড়ে ফেলে উৎসা উঠল, স্নান সারতে হবে। গরম ঠান্ডা জল অ্যাডজাস্ট করে নব ঘোরালো। আরাম লাগছে। খারাপ চিন্তাগুলো মাথা থেকে বেরিয়ে ফেনা-জলের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে। দেয়ালের নীল রঙের টাইলস কেটে যাওয়া নেশার ভাবটা ফিরিয়ে দিচ্ছে। সমস্ত গ্লানি, অপরাধবোধ , পাপবোধ স্ক্রাবার দিয়ে ঘষে ঘষে তুলে ফেলছে উৎসা। নিজের একটা জীবন আছে, অনেকদিন পরে সেই বোধটা ফিরে আসছে। গলাটা যথাসম্ভব নামিয়ে গুন গুন করে গানও গাইছে। দরজার বেলটা দুবার বাজলো। গা মাথা কোনো রকমে মুছে সাদা বাথরোব পরে দরজা খুলতেই ঋদ্ধিকে দেখতে পেল। সে সদ্য স্নাত উৎসাকে দেখে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে। একটু তুতলে বলল, 

বেরোচ্ছি, সবাই বাইরে অপেক্ষা করছে।

 

উৎসা বাইরে গিয়ে পৌঁছলো মিনিট দশেক পর। ওদের দলটা তখন অধৈর্য হয়ে পড়েছে। কোনরকমে বিদায় পর্ব সেরে উৎসাকে রিসর্টে রেখে ওরা সবাই রওনা দিল কেদারনাথের পথে। যাবার আগে ‘তাহলে আসছি’ বলে করুণ চোখে তাকিয়ে গেল ঋদ্ধি। গাড়িটা যতক্ষণ না চোখের আড়াল হয় ততক্ষণ গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল উৎসা, তারপর একটা নির্ভার মন নিয়ে লনে এসে বসল। আসেপাশে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বিদেশি দলটা কোন ঘর গুলোতে উঠল কে জানে। গতকাল দোতলার পুব দিকের বারান্দায় সায়া ব্লাউজ শুকোতে দেখেছে উৎসা, আজ নেই। মনে হয় ওরা চলে গেছে। একবার ঘাট থেকে ঘুরে এলে হয়। নাহ থাক। বিকেলেই যাওয়া যাবে। সূর্যটা প্রায় মাথার উপরে, যদিও উত্তাপটা গায়ে লাগছে না। শুকোবে বলে চুলটা এলিয়ে দিল উৎসা। আর ঠিক তখনই পিছন থেকে সদ্য চেনা গলাটা ভেসে এল।

 

হাই! এনজয়িং উত্তরাখন্ড? 

 

উত্তরে সামান্য হাসলো উৎসা। ছেলেটা হাসি ফিরিয়ে দিল।

 

বিদেশি দলটা কোথাও একটা বেরোচ্ছে। মনে হয় কাছাকাছিই, পিঠের ঢাউস ব্যাকপ্যাক গুলো নেই। উৎসাকে হাত নেড়ে বাই করল। নীল চোখের ছেলেটা একটা খাকি রঙের ঢোলা প্যান্ট আর সাদা টিশার্ট পরেছে। চুলে ছোট্ট পনিটেল। ওরা চলে গেলে উৎসার মনটা খালি হয়ে গেল। ওকে ডাকতে পারত, দেখল একা বসে আছে…

 অনেকটা দূরে একটা পাহাড় চুড়ো দেখা যাচ্ছে। ওটা আগেও ছিল? নাকি তুলি দিয়ে আজই আঁকা হয়েছে? কেউ একটা আসছে। চোখ ফেরাতেই দেখল  নীল চোখের ছেলেটা ব্যস্ত হয়ে  ফিরছে, কিছু একটা ভুলেছে বোধহয়। উৎসার ধারণাই ঠিক। রুম থেকে রোল করা একটা কাগজ হাতে নিয়ে বে্রিয়ে এল। চোখাচোখি হতেই বলল,

 ম্যাপটা নিতে ভুলেছিলাম। উৎসা হাসল ।

 

তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে আসতে পারো, ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরব।

 

উৎসা এতক্ষণ এটাই চাইছিল, তবে ব্যাগ্রতা দেখালো না। লাঞ্চটাও হয়নি। তাহোক, ধীরে সুস্থে জিজ্ঞেস করল ‘কোথায়?’ 

 

নদী চেনাবো।

 

টাকা পয়সা, ফোন কিছুই সঙ্গে নেই, নিয়ে আসি?

 

প্রয়োজন কী? জলদি এসো, দলটা অপেক্ষা করছে।

 

মাথার ভিতর ঘুরতে থাকা অজস্র প্রশ্ন নিয়ে ছেলেটার পিছু নিল উৎসা, কেন নিল নিজেও জানে না। সে কি নদী চিনতে চায়? নাকি ছেলেটাকে? ছেলেটা হিন্দি বলে কী করে? 

 

তোমার সঙ্গে আলাপ হয়নি, আমি নীল জোন্স উপাধ্যায়। তোমার নাম আমি জানি, রাপুনজেল। তাই তো? বলেই মিটিমিটি হাসল।

 

মোটেই না। সবার জীবন কি আর রূপকথা হয়?  আমি উৎসা মুখার্জি। কলকাতায় থাকি।

 

ওয়াও! সিটি অফ জয়?

 

তুমি চেনো কলকাতা? উৎসা অবাক হয়।

 

বার দুয়েক গেছি। কলকাতা চিনব না কেন! বাই বার্থ আমি ব্রিটিশ নাগরিক হলেও আদতে শরীরে ইন্ডিয়ান রক্ত বইছে। আমার পূর্ব পুরুষ থাকতেন হরিদ্বারে। তবে ঠাকুর্দা পড়াশোনা করতে বিদেশে যান ওখানেই সেটল করেন, বাবার জন্মও লন্ডনে। আমার মা ব্রিটিশ। আমি মায়ের চেহারাটা পেয়েছি।

 

এখন কি আপনি  ইন্ডিয়াতেই থাকেন? মানে আপনার হিন্দি শুনে মনে হল।

 

আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমাদের দেশের বাড়ি মানে হরিদ্বারে খবর পাঠাই। বাবা লন্ডনে মানুষ হলেও দেশের সঙ্গে একটা ক্ষীণ যোগাযোগ ছিলই। সম্পর্কে আমার এক কাকা আমাকে ইন্ডিয়াতে ডেকে পাঠান এবং একটি ছোট্ট বাড়ির কাগজপত্র আমাকে ধরিয়ে দেন। উনি না জানালে দাদুর ভিটের কথা আমি জানতেও পারতাম না। যাইহোক বাড়িটা নিয়ে মুশকিলে পড়লাম। এদেশে স্থায়ী ভাবে বসবাস করার পরিকল্পনা ছিল না, বিক্রি করতেও মন চাইল না। নিজের জন্য একটা ঘর রেখে বাকি অংশ ভাড়া দিলাম এক ট্রেকিং কোম্পানিকে। আমার এক তুতো-ভাই সেই কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। পরের বার এদেশে ফিরে ওদের সঙ্গে ট্রেকে গেলাম। রাফটিং করলাম। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। ট্রেকিং, র‍্যাফটিং করাটা নেশায় পরিনত হল। এই পাহাড়ের টানেই ফিরে ফিরে আসি। লন্ডনে ওই অফিসেরই একটা ব্রাঞ্চ খুলেছি। যদিও আমি চালাই না, লোক আছে। আমি আদতে অধ্যাপক। ইংরেজি লিটারেচার পড়াই। বছরে একবার ইন্ডিয়া আসি, মাস দুয়েক থাকি। বিদেশিদের ট্রেকিং করাই, রাফটিং করাই…

 ও হ্যাঁ হিন্দি ভাষাটা আমি ভাইয়ের কাছ থেকে শিখে নিয়েছি, তবে এখনো ভারতীয়দের মতো উচ্চারণ করতে পারি না।

 

উৎসা মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনছিল। নীল যেন গল্পের কোন চরিত্র। ভিতরটা অকারণেই উথালপাথাল করছে।

 

তোমার কথা কিছু বললে না তো?

 

আমার স্বামী কয়েকমাস আগে মারা গেছেন। তার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে এখানে আসা।

 

আমি দুঃখিত, খুবই খারাপ ঘটনা। মাই সিনসিয়ার কন্ডোলেন্স টু ইউ এন্ড ইয়োর ফ্যামিলি।

 

‘ফ্যামিলি’ শব্দটা শুনে উৎসা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মৈনাক মারা যাবার কথাটা কি না বললেও হত? কিন্তু বলবে না কেন? সে তো মৈনাকের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়। খানিকটা পথ নীরবে কাটল। দূরে বাকী দলটাকে দেখা যাচ্ছে। নীল নীরবতা ভেঙে বলল,

 যা হয়ে গেছে তা পরিবর্তন করা যায় না। এখন সামনের দিকে তাকিয়ে বাঁচা ভাল। তুমি র‍্যাফটিং করতে যাবে? আগামীকাল? দেবপ্রয়াগ টু ঋষিকেশ। মাঝে একটা রাত নদীর তীরে টেন্টে থাকা… 

 

র‍্যাফটিং! আমি কোনোদিন করিনি, পারব নাকি!

 

 উৎসা বেশ অবিশ্বাস নিয়ে নীলের মুখের দিকে তাকায়। ওর মুখের অবস্থা দেখে হেসে ফেলে নীল। বলে,

 সবারই তো একটা প্রথমবার থাকে নাকি?  দলে দুজন মহিলারও প্রথমবার। ছোট্ট ট্রেনিং লাগে, আজ দুটো ভাগে সেটাই দেওয়া হবে। তবে সুইমিং না জানলে অ্যালাউ করা যাবে না। 

 

সুইমিংটা ভালোই পারি। উৎসা সাহস দেখিয়ে বলে। আসলে ওর সুইমিংটা মিসেস শ্রীনিবাসনের অনুগ্রহেই শেখা…

 

গুড, তবে তো তুমি পারবে। যথেষ্ট ফিট তুমি।

 

দেখি, ঠিক কনফিডেন্স পাচ্ছি না। আর… শেষ না করেই থামল উৎসা।

 

 ওরা সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। এটা অন্য ঘাট, একটু ফাঁকা। এদিকটায় ভাগীরথী বইছে। নদীর পাশে বড় বড় পাথর আর রূপোলী বালি দেখতে পেল উৎসা। সিঁড়ির পাশে একটা গুমটি। সেখানে খানকয়েক হাওয়া দিয়ে ফোলানো ডিঙি, লাইফ জ্যাকেট আর বেশ কিছু দাঁড় ডাঁই করে রাখা। সামনে প্লাস্টিকের টেবল, তাকে ঘিরে কটা চেয়ার পাতা। সেই টেবিলে ম্যাপটা পেতে ভাগীরথী আর অলকানন্দার উৎস চেনাচ্ছে নীল। দেবপ্রয়াগে কেমন করে দুটো নদী মিলছে, তার গভীরতা কত, জলের উত্তাপ, স্রোতের রকমফের নিয়ে অনর্গল কথা বলছে, দলের অন্যদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, উৎসা শুনছে। যদিও মনটা অন্যখানে। কোন ব্র্যান্ডের পারফিউম মাখে নীল? একটা ঝিম ঝিম  গন্ধ ভেসে আসছে , শুধুই গন্ধ? নাকি উত্তাপও ? 

 

অনেকটা দূরে বাগওয়ান নামের একটা জায়গায় রাস্তার ধার ঘেঁষে বড়সড় গাড়িটা দাঁড় করিয়েছিল শুভঙ্কর, তার চা তেষ্টা পেয়েছে। বাকিরা তাড়াতাড়ি পৌঁছতে চাইছিল, তবে চায়ের নামে পুরো দলটাই নেমে এল। এখানে ঠান্ডাটা একটু বেশিই। শ্রমণা গায়ের শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে উৎসার নম্বর ডায়াল করল, বেজে যাচ্ছে। তিন চারবার চেষ্টা করেও পাওয়া গেল না।

 

কী রে ধরছে না? অন্বেষা জিজ্ঞাসা করল। বাকি সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

 

শরীর খারাপ হল নাকি? মানে জ্বর-টর… ঋদ্ধি বলল।

 

তোমার দেখছি চিন্তার শেষ নেই! বরং একটা ফিরতি গাড়ি ধরো, তারপর গিয়ে মাথায় জলপটি দাও বাতাস করো। আসার আগে খুব তো ‘তাহলে আসি’ বলে এলে। চক্করটা কী ঝেড়ে কাশো তো….

 

এই জন্য বললাম ওর বিয়ে দিয়ে দে। বর গুলোর মাথা খাবেই এই বলে দিলাম।

 

 অন্বেষার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল শ্রমণা। -ও তুই এইজন্য বললি ওর বিয়ে দেয়া উচিত?

 

নয়তো কী? তুই কী ভাবলি?  অন্বেষার ঠোঁটে তীর্যক হাসি।

 

রিশেপসনে ফোন করলে হয় তো…শুভঙ্কর বুদ্ধি দেয়। করা হয়। ওরা জানায় ম্যাডামজি ফরেনার লোগোকে সাথে বাহার গিয়া।

 

প্রায় সবাই একযোগে বলে “ফরেনারদের সঙ্গে?” 

 

এ কি তুমি আমি, যে ইংরেজিতে গল্প করতে গিয়ে হেলে কেঁপে মরব।  এলেম আছে মহিলার। ফরেনার জুটিয়ে ফেলল? সেই নীল চোখের ছেলেটা নাকি? কী হ্যান্ডসাম ছিল তাই না?  মধুরা আসার সময় রিশেপসনে নীলকে এক ঝলক দেখেছিল, ভোলেনি।

 

মধুরার কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে উঠল শুভঙ্কর।

তিনকাল গেয়ে এককালে ঠেকল নোলা গেল না। কী হ্যান্ডসাম! নিজের চেহারাটা দেখেছ?

 

ভাগ্যিস তোমার বউ উৎসার মতো সুন্দরী নয়, নইলে চরিত্রহীন বউ নিয়ে ঘর করতে পারতে? 

 আলোচনাটা কদর্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। অজয় ধমক দিয়ে বলল,

 আহ! তোরা চুপ করবি? এই করে ট্যুরটা স্পয়েল করিস না। আমরা কেউই ওর অভিভাবক নই, ও কি করবে ওর ব্যাপার। যে কাজের জন্য আসা হয়েছিল সেটা মিটিয়ে দিয়েছি ব্যাস…

 

বাব্বা তোমার হলটা কী? খুব বড় বড় বাত ঝাড়ছ?  সব কটার মাথায় খেয়েছে দেখছি! হ্যাঁ গো কখন খেল? এই মেয়ে নিশ্চয় বশীকরণ জানে…… শ্রমণার কথায় হেসে ওঠে সবাই। তবে সবার মনেই জ্বালা, সেই জ্বালার ধরণ এবং কারণ যদিও এক নয়।

 

বশীকরণ কাকে বলে নীল জোন্স উপাধ্যায় জানে না। তবে সে কিছুতেই উৎসা নামের মেয়েটাকে মাথা থেকে বের করে দিতে পারছে না। ভিতরে অদ্ভুত এক উত্তেজনা হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া প্রেমের চিঠি খুঁজে পেলে যেমনটা হয় ঠিক তেমন। উৎসা র‍্যাফটিং-এ যেতে চাইবে তো? যদি না চায়? এটাই যদি শেষ দেখা হয়? নীল আর কোনোদিন খুঁজে পাবে উৎসাকে? 

 

সুনেত্রা সাধু

Nabanita Santra

পুকুরঘাট

একদিন আমরা মাত্র কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুকুরঘাট নামের একটি মেয়েদের ভার্চুয়াল দল খুলে ছিলুম। অচিরেই সে কয়েকটি সদস্যের দল কয়েক হাজার সদস্যের মেয়েদের দল হয় ওঠে। পুকুরঘাট দলের মত এত গুণী মেয়েদের সমাহার বাংলাদেশে খুব কম ভার্চুয়াল দলে আছে। কাজেই সেই দল সেখানেই আটকে থাকবে না বলা বাহুল্য। তাই পুকুরঘাট দলের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে প্রকাশিত হলো পুকুরঘাট পত্রিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Others Episodes