তিন ভাগের একভাগ

শ্যামলী আচার্য
“ডাকছিলেন স্যার?”
পূর্বা স্লাইডিং কাঁচের দরজা সামান্য ঠেলে ভেতরে মুখ বাড়ায়।
ঘরের ভিতরে অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। তাপমাত্রা কমানো রয়েছে। সকাল এগারোটা নাগাদ এতটা ঠাণ্ডা খুব অস্বস্তিকর। বিশেষ করে রোদে-গরমে তেতেপুড়ে ঝলসে এসে এই ঘরে ঢুকলে প্রথমে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পরে খুবই কষ্ট হয়। ঠাণ্ডা-গরমে বিধ্বস্ত লাগে। বিশেষত আবার যদি এই হিমঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে কাজ করতে হয়, তাহলে ব্যাপারটা বেশ অসুবিধেজনক।
ঘরের ভিতরে কাঠের চেয়ারে যে ভদ্রলোক বসে রয়েছেন, তাঁর চোখ কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে। গম্ভীর।
দরজার শব্দে ফিরে এক ঝলক তাকিয়েই পূর্বার কথায় মৃদু হাসলেন।
“ভেতরে এসো পূর্বা। আজ কি দেরি হল তোমার?”
পূর্বা চট করে ঘড়ি দেখে। ঘরের মধ্যেই দেওয়ালে একটি বিরাট গোল ঘড়ি। এগারোটা বেজে চার মিনিট। পূর্বাকে এগারোটায় আসতে বলেছিলেন। পূর্বা জানে, উনি ঠিক দশটা উনষাট থেকে ঘড়ি দেখেছেন। তারপর আর দেখেননি। কারণ, এগারোটা বেজে গেছে মানেই লেট। আর এই বিষয় নিয়ে আর কোনও কথা উনি শুনবেন না। বলে লাভ নেই।
পূর্বা ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে। দরজাটা খুব আস্তে বন্ধ করে দেয়। গভীর নির্জনতায় কোনও ব্যাঘাত না ঘটে।
“একটা রিপোর্ট দরকার পূর্বা। তোমাকেই কাজটা করতে হবে। সেজন্যেই তোমাকে ডেকেছি। কিন্তু খুব সিক্রেটলি এই বিষয়টা গোছাতে হবে।”
“বলুন স্যার। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব”।
পূর্বা ভেতরে ভেতরে একটু চিন্তিত হলেও মুখে প্রকাশ করে না। ডঃ অনুপম সেন টেনশন বা স্ট্রেস একদম পছন্দ করেন না। তিনি প্রচণ্ড কাজের মানুষ। এবং ভীষণ পরিশ্রমী। নিজে অক্লান্ত খাটেন, তাঁর রিসার্চ স্কলারদের কাছ থেকেও সেই খাটনি প্রতি মুহূর্তে কড়ায়-গণ্ডায় ফেরত নেন।
অনুপম তাকিয়ে দেখেন তাঁর অন্যতম সেরা ছাত্রীটির দিকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশবিদ্যা নিয়ে পড়েছে পূর্বা। একটি পোশাকি ডক্টরেট ডিগ্রি রয়েছে তার। কিন্তু অনুপম সেনের কাছে পোস্ট ডক্টরেট করতে এসকলেই তাঁর কাজের ধরনের সঙ্গে পরিচিত। তটস্থ হয়ে থাকে।
“শোনো পূর্বা, ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যাণ্ড নিয়ে আবার একটা বড় কাজ এসেছে। একটা বিরাট সার্ভে আর তার রিপোর্ট। চুপচাপ কাজটা করতে হবে। আর সেই কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট পাঠাতে হবে অনেক বড়সড় জায়গায়। বিরাট লড়াই আসছে। তৈরি হও।”
পুর্বা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় সে কথা বলবে না। এই সময় কোনও কথা বলা যায় না। কোনও অবাঞ্ছিত কৌতূহল, তাড়াহুড়ো অনুপম সেন পছন্দ করেন না। এটা শোনার সময়। বলার জন্য প্রচুর অবকাশ থাকবে। স্যার নিজেই বলার সুযোগ দেবেন। সমস্ত রকমের প্রশ্নের জট ছাড়িয়ে দেবেন ধীরে ধীরে।
এখন পূর্বা তো নিজেকে শুধু একজন রিসার্চ স্কলার ভাবে না। সে নিজেকে অ্যাক্টিভিস্ট ভাবতে শুরু করেছে। শুধু পরিবেশ-বিজ্ঞানী নয়, আদ্যন্ত পরিবেশ-সংগ্রামী। অনুপম নিজেকেও তাই ভাবেন।
অনুপম কম্পিউটারে একটা ম্যাপ খুলে দেন পূর্বার সামনে। স্যাটেলাইট ইমেজ। বাইশ ডিগ্রি সাতাশ মিনিট নর্থ, অষ্ট আশি ডিগ্রি সাতাশ মিনিট ইস্ট। একটা অক্ষরেখা আর অন্যটা দ্রাঘিমারেখা। যা দিয়ে পৃথিবীর যে কোনও জায়গার স্থানিক মাপ খুঁজে নেওয়া সম্ভব। এই দাগের মধ্যে আপাতত রয়েছে মোট প্রায় বারো হাজার পাঁচশো হেক্টর জমি। জমি বলা ভুল। জলাজমি, বা জলাভূমি। পূর্ব কলকাতার বিস্তীর্ণ জলাভূমির একটা নিখুঁত মানচিত্র। জল শুধু জল। যে জল পৃথিবীকে সবুজ করেছে। বাসযোগ্য করেছে।
“স্যার, এর মধ্যে কিছু জায়গায় তো নিজে গিয়ে কাজ করেছি আমি”।
“আমি জানি। জলের পলিউশন লেভেল নিয়ে কাজ করার সময় তুমি একটা তুলনামূলক ডেটা দিয়েছিলে। খুবই খেটেছিলে। আই অ্যাপ্রিসিয়েট ইওর ডেডিকেশন। কিন্তু এই পাঁচ বছরের তুলনামূলক তথ্য লিখে আমাদের পৃথিবীকে আর কোনওভাবেই বাঁচানো যাবে না। ওই সব গবেষণার ফলাফল তুমি নিজেও হাড়ে হাড়ে জানো। রিসার্চ ফর রিসার্চস সেক। আসলে, এই জায়গাটা নিয়ে প্রচুর সমস্যা তৈরি হচ্ছে পূর্বা। এই জায়গাটা খুব বিপন্ন। একে সবদিক থেকে বাঁচাতে হবে। আর কিছু ফীল্ড ওয়ার্ক তোমাকেই গিয়ে করতে হবে। সেইজন্যেই ডেকেছি তোমাকে”।
বাইরে খুব গরম। বৈশাখের কাঠফাটা রোদ। পূর্বার মনে পড়ে বছর তিন-চারেক আগেও এই চড়া রোদের মধ্যেই একের পর এক পুকুর, পরিত্যক্ত জলাজমি, ভেড়ি, বিল– সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে হত তাকে। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। টানা পাঁচ বছর। তখন এই অঞ্চল থেকেও জলের স্যাম্পেল নিয়ে সোজা ল্যাবে আসতে হয়েছে। চলেছে জলের চুলচেরা বিশ্লেষণ।
ফ্রেশ ওয়াটার ইকোলজিতে পূর্ব কলকাতার এই বিস্তীর্ণ জলাভূমি আটের দশকের শুরু থেকেই অন্যতম গবেষণার কেন্দ্র। কলকাতা, উত্তর চব্বিশ পরগণা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক নোনা জলের বিল। কলকাতার নিকাশিক্ষেত্র। একে ইকোলজি স্পেশাল ক্লাসে পড়ানোর সময় বলা হয়েছিল, এই বিরাট জায়গাটা হল কলকাতার কিডনি। শহরের যা কিছু বর্জ্য, যতরকমের আবর্জনা সব এই জলাভূমি ছেঁকে নিচ্ছে। রীতিমতো চর্চা তখন এই জলাভূমি ঘিরে। পরিবেশবিজ্ঞানীদের সেই আগ্রহ এখনও রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীর আগ্রহে রাষ্ট্রের কখনওই কিছু এসে যায় না।
“খনার বচন পড়েছ পূর্বা?”
“ইয়ে, হ্যাঁ, মানে…ঠিক কোনটা স্যার?” পূর্বা একটু থমকে যায়।
“খনার বচনে বলা হয়েছে পুবে হাঁস পশ্চিমে বাঁশ… এই বচনটির মানে জানো?”
অনুপম মৃদু হাসেন। নিরুত্তর পূর্বা। স্যার যে কখন কোত্থেকে কীভাবে রেফারেন্স টেনে আনেন! এই সময় চুপ করে থাকাই শ্রেয়।
“খনার এই বচনের সঠিক মানে হল, বাড়িতে হাঁস, মুরগির খামার বানাতে হবে পুব দিকে। আর পশ্চিম দিকে থাকবে বাঁশ বন, যেখান দিয়ে হাওয়া বয়ে যায়। হাঁস, মুরগির খামার যখন থাকবে পুব দিক ঘেঁষে, তখন সহজ বুদ্ধিতে জলাশয়ও থাকা প্রয়োজন বাড়ির পুব দিকে। বাস্তুবিজ্ঞানের নিরিখে খনার এই বচন আজও কিন্তু অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। মুশকিল হল, আমরা লোককথার আড়ালে থাকা বিজ্ঞান কোনওদিন মনেও রাখিনি, ভাবিও না এগুলো নিয়ে”।
পূর্বা বুঝতে পারে আপাতসরল কথার আড়ালে একটি অন্য কোনও বিষয় তুলে আনতে চাইছেন স্বনামধন্য পরিবেশবিজ্ঞানী ডঃ অনুপম সেন।
“ভালো করে ভেবে দেখ, কলকাতারও পূর্বে রয়েছে বিরাট জলাভূমি আর পশ্চিমে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। স্বাভাবিকভাবেই এটি প্রকৃতির এক অনবদ্য সৃষ্টি। আমরা অনেকেই জানি না, কলকাতা শহরের পুরো ঢালটাই কিন্তু পূর্ব দিকে। কলকাতার এই পুব দিকে ঢাল থাকার জন্য শহরের একটি বড় অংশের নিকাশি নালার জল প্রবাহিত হয় সে দিকেই। এ এক আশ্চর্য দেওয়া-নেওয়া। এই ওয়েটল্যাণ্ড ক্রমাগত বুক পেতে নিচ্ছে শহরের যাবতীয় দূষিত জল। আর তার বদলে আমাদের ফেরত দিচ্ছে শোধিত জল। ওই নোংরা জলের বিনিময়েই কলকাতা পাচ্ছে বিপুল পরিমাণ মাছ আর সবজি। এখানকার, মানে, পূর্ব কলকাতার জলাভূমির মৎস্যজীবীদের হিসেবে, বছরে দু’ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে। প্রতিদিন কলকাতার টাটকা মাছের অন্তত পঁচিশ শতাংশ জোগান দেয় এই পূর্ব কলকাতা জলাভূমিই। এরা নিচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইড, দিচ্ছে অক্সিজেন। একেই বলে পরিবেশের ভারসাম্য। অথচ কলকাতার বাতাসের অবস্থা ভাবো। রোজ কী হারে দূষণ বাড়ছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে শ্বাস নিতে ভয় করে, বিকেলে রাস্তায় হাঁটতে বেরোলে দম বন্ধ হয়ে আসে।”
একটানা কথা বলতে বলতে একটু থামলেন অনুপম।
“তুমি নিশ্চই বুঝতে পারছ পূর্বা, আমি কী বলতে চাইছি। ওই জলাভূমি সব অর্থে বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের। আমরা সবকিছুই সিলেবাসে পড়ি, মুখস্থ করি, নম্বর পাই। তারপর পরীক্ষা পাশ করে এগুলো সব ভুলে যাই”।
“আমি বুঝেছি স্যার। আর বলতে হবে না। নিশ্চিতভাবে এই জলাভূমি এবার একটু একটু করে বিপন্ন হবারই কথা। অতটা জায়গা…”।
“একদমই তাই। তবে খুব পাতি বিপন্নতা নয়। ওই জায়গাটা দীর্ঘদিন ধরে যারা বাঁচিয়ে রেখেছে, এবার তাদের স্বার্থরক্ষার লড়াই। আর আমাদের কাজটা হবে আন্তর্জাতিক স্তরে। এইসব কাজে পাড়ার পাতি প্রোমোটারদের নরমে-গরমে আটকাতে গেলে তুমি স্রেফ মারা পড়বে, আমাদের আরও অনেক বড় দাদা ধরে এই সর্বনাশটা আটকাতে হবে”।
পূর্বার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।
“কিন্তু এটা তো ‘রামসার সাইট’… সংরক্ষণের আওতায়…”
“তাতে কী আসে যায় পূর্বা? এই পোড়া দেশে এইসব কথা অর্থহীন। ওখানকার মানুষ এইসব রামসার কনভেনশনের কথা শুনেছেন কখনও? তোমার চারপাশের তোমার আমার নিজেদের বাড়ির ক’টা মানুষই বা শুনেছেন? কীসের রামসার আর কোথাকার কনভেনশন… খায় না মাথায় মাখে… না ল্যাজে মাখিয়ে রোদ্দুরে শুকোয়… কে তার খবর রাখে! ভিটেমাটি ভেঙেচুরে বাঁধিয়ে সবাই শুধু ফ্ল্যাট বানাতে ব্যস্ত…”
“কিন্তু স্যার, আমরা যদি ইউনাইটেড নেশনসে আবার জানাই? আপনার কথা কিছুতেই ফেলতে পারবে না ওরা…”
“কে বলল জানাইনি? ওদের ভরসাতেই তো এতকাল… কিন্তু এখন সিচুয়েশন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে পূর্বা। বাড়িতে দেখোনি, দুষ্টু বাচ্চারা কিছুতেই বাপ-মায়ের কথা শোনে না, হাজার রকম ফন্দি-ফিকির বের করে দুষ্টুমিটা ক্রমাগত চালিয়ে যায়… আর এটা তো আর সরল দুষ্টুমির পর্যায়ে নেই। পুরোটাই বদমাইশি। লোভ আর লোভ।”
“আমি আছি স্যার। কী করতে হবে বলে দিন”।
অনুপম হাসেন। স্বস্তির হাসি।
“জানি, তুমিই পারবে”।
শ্যামলী আচার্য
শ্যামলী আচার্যের লেখা পড়ে বহু অজানা তথ্যের আলোয় আলোকিত হলাম। যে ব্যাপার গুলি ভাসা ভাসা জানতাম সেগুলি লেখিকার বর্ণনায় স্পষ্ট হয়ে উঠল। লেখাটির জন্য ধন্যবাদ জানাই।